কোয়াডে যেকোনোভাবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে বলে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং যে মন্তব্য করেছিলেন, তা নিয়ে দেশ-বিদেশে সীমিত পরিসরের একটা কূটনৈতিক আলোড়ন দেখা গেছে। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা, ওয়াশিংটন ও বেইজিং থেকে ওই মন্তব্যের পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়। দিল্লি থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানো হলেও বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের পাল্টা জবাবটি এসেছে একজন ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নসূত্রে। সোজা কথায়, চীনা রাষ্ট্রদূতের কথায় সবাই একটু নড়েচড়ে বসেছেন।
চীনা রাষ্ট্রদূত তাঁর কথায় যে হুঁশিয়ারির সুর ছিল, তা হালকা করার চেষ্টায় একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পররাষ্ট্রনীতির প্রতিনিধিত্ব করে যে পত্রিকা, সেই গ্লোবাল টাইমস-এর নিবন্ধ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বিষয়টি মোটেও হালকা হয়নি। বলা চলে, চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বরং রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের মন্তব্যের যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টার অভিযোগের ইঙ্গিতপূর্ণ জবাবে বলেছেন যে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীন কখনো নাক গলায় না। জবাবটি ইঙ্গিতপূর্ণ কেন, এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আমাদের বিতর্কিত নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে ভারতেরও আগে চীনের স্বীকৃতিতে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের স্বীকৃতি দেওয়ায় এগিয়ে ছিল ভারত।
বাংলাদেশকে নিজ নিজ প্রভাববলয়ে টানার চেষ্টায় ভারত ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বহুল আলোচিত। এ প্রতিযোগিতায় সর্বসাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের অনানুষ্ঠানিক জোট, চতুষ্টয় বা কোয়াড। এ চতুষ্টয়ের সংঘবদ্ধ অবস্থান সংহত করার লক্ষ্যে যেসব কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতার পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায়ও এগিয়ে থাকার প্রশ্ন রয়েছে। টিকা-কূটনীতি যে তারই অংশ, সে বিষয়েও খুব একটা রাখঢাক নেই। গত ১২ মার্চ এ চতুষ্টয়ের নেতারা এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় ভারতে ২০২২ সালের মধ্যে ১০০ কোটি ডোজ কোভিড-১৯-এর টিকা উৎপাদনে সব ধরনের সহযোগিতার বিষয়ে সম্মত হন। স্পষ্টতই চীনা টিকার সম্ভাব্য কূটনৈতিক ও বাজার সম্প্রসারণের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের সক্ষমতা বৃদ্ধির এ তাগিদ।
স্মরণ করা যেতে পারে, চীনা একাধিক প্রতিষ্ঠান টিকা উদ্ভাবনের প্রক্রিয়াতেই বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চেয়েছিল এবং অন্তত একটি টিকার ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা পরীক্ষায় বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছিল। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তখন দেশটির কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এ বিষয়ে একধরনের অস্থিরতা দেখা যায়। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকা উৎপাদনের সুবাদে ভারত তখন কিছুটা বাড়তি সুবিধা লাভ করে। অন্যদিকে, চীনা টিকার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়। এখন আবার চীনা টিকা অপরিহার্য হয়ে পড়ায় চীন যে আবারও কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থা ফিরে পেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। টিকার প্রশ্নে দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনায় তাই চীনা রাষ্ট্রদূত সংযমের কথা একটুও ভাবেননি।
বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়াকেন্দ্রিক নতুন উদ্যোগ কোয়াডের বিষয়ে চীনের অধৈর্য হয়ে ওঠার বিষয়টি কতটা আকস্মিক, তা বোঝার জন্য আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নিবিড়ভাবে নজর দেওয়া দরকার। ওয়াশিংটনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু বৈশ্বিক অনেক নীতির ক্ষেত্রেই বাইডেন প্রশাসন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তবে একটি ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের নীতি তাঁর পূর্বসূরি ট্রাম্পের থেকে একটুও বদলায়নি। এটি হচ্ছে চীননীতি। চীনের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের যে প্রথম বৈঠক হয়েছে, সেখানেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো পদক্ষেপ ঘোষণা এখনো চলছে। দক্ষিণ চীন সাগরে বিভিন্ন দ্বীপের বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া, তাইওয়ানের স্বীকৃতি, হংকংয়ের গণতন্ত্র এবং উইঘুর মুসলিমদের জাতিগত নিপীড়নের অভিযোগ ঘিরে বিরোধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি অবাধ ও মুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোটে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অংশগ্রহণের জন্য নানা ধরনের চাপ এবং প্রণোদনার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে অনেক দিন ধরেই। এর পাশাপাশি এই কোয়াড সম্প্রসারণের কথাও এখন জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। স্বভাবতই চীন বাড়তি চাপ অনুভব করছে এবং এশীয় প্রতিবেশীদের নিজস্ব প্রভাববলয়ে টানতে ও ধরে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।
সন্দেহ নেই, ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের এ টানাপোড়েন বাংলাদেশের জন্য একটা খুবই নাজুক ভারসাম্যের বিষয় হয়ে রয়েছে। এ দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী ভারতের অবস্থানও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ায় আঞ্চলিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় ভারত ও চীন যেমন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী, ঠিক তেমনই মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র চায় এশিয়ায় তার স্বার্থ রক্ষায় ভারতের নেতৃত্ব সংহত হোক। ফলে ওয়াশিংটন ও দিল্লির পদক্ষেপগুলোকে বেইজিং যে সন্দেহ ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে দেখবে, সেটাই স্বাভাবিক। ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্তের, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক’—এমন মন্তব্য যে তাদের উৎকণ্ঠা আরও বাড়াবে, তা স্বাভাবিক। বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিকভাবে সমরাস্ত্রের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল, এটা মোটামুটি সবারই জানা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সমরাস্ত্র ও সরঞ্জামের জন্য বাংলাদেশ অন্যান্য উৎসেও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এখন পাশ্চাত্যের দেশগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে বেশ কিছু সামরিক সরবরাহ আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরবরাহ ধীরে ধীরে বাড়ছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার প্রয়োজনে কেনা হয়েছে মাইন প্রতিরোধী এমআরএপি সামরিক যান। সম্প্রতি এসেছে গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য জরুরি ওয়াস্প এই ইউএএস ড্রোন। অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ও ক্ষেপণাস্ত্র কেনার প্রস্তাবও আলোচনায় আছে। নিকেই এশিয়া গত ২২ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতায় উদ্যোগী হয়েছে, তার বিবরণ তুলে ধরে। ‘ইউএস ইউজেজ ডিফেন্স ডিপ্লোমেসি টু উ বাংলাদেশ অ্যাওয়ে ফ্রম চায়না’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, যেখানে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় এমন এক ‘উদীয়মান’ মিত্র হিসেবে বাংলাদেশকে আকৃষ্ট করতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তৎপরতা জোরদার করেছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের মাত্র ১০ দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছিলেন। ওই টেলিফোন পর্যবেক্ষকদের কিছুটা বিস্মিত করেছিল দুটো কারণে। প্রথমত, ট্রাম্প প্রশাসন যখন বিদায়ের দিন গুনছে, তখন সামরিক সহযোগিতার বিষয় আলোচনা এবং দ্বিতীয়ত, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সরাসরি এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার নজিরও খুব বিরল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের সেদিনের বিবৃতিতে বলা হয়, উভয় নেতা একটি অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, যেখানে সব দেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয় এবং সামুদ্রিক, আঞ্চলিক নিরাপত্তাসহ দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা অগ্রাধিকারের বিষয় ও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতার আধুনিকায়নের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন। উভয় নেতা অভিন্ন মূল্যবোধ ও স্বার্থে দ্বিপক্ষীয় সামরিক সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠতরভাবে গড়ে তোলায় নিজেদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিকৌশলের গুরুত্বপূর্ণ শরিক ভারতও যে বাংলাদেশের সামরিক চাহিদা পূরণে অংশ নিতে কতটা আগ্রহী, তা–ও কারও অজানা নয়। ৫০ কোটি ডলারের ঋণ দিয়ে অস্ত্র সরবরাহের যে সমঝোতা হয়েছে, তার কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। একই সঙ্গে ভারতীয় বিশ্লেষকেরা চীনা সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে যেভাবে সমালোচনায় মুখর ছিলেন এবং এখনো আছেন, তা–ও কারও নজর এড়ানোর কথা নয়। চীনা প্রশিক্ষণ বিমানের একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁরা চীনা সমরাস্ত্রের গুণগত মান ও নির্ভরযোগ্যতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এ পটভূমিতে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী গত ডিসেম্বরে নেপাল থেকে চীন যাওয়ার পথে ঢাকায় আসার আগ্রহ দেখালেও শেষ মুহূর্তে সেই সফর বাতিল হয়ে যায়। তার ঠিক চার মাস পর তিনি ঢাকায় এলেও সে সফরে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনার কথা জানা যায় না। তিনি কোয়াড সম্পর্কে চীনের অবস্থান তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতির কাছে। কাছাকাছি সময়ে মহামারির মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরিসহ অনেক বিদেশি রাষ্ট্রনেতা ও প্রতিনিধি ঢাকা সফর করেছেন এবং শীর্ষ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীগুলোর টানাপোড়েনের এ পটভূমিই কি চীনকে কিছুটা অস্থির করে তুলেছে? নাকি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে খারাপ প্রভাব পড়ার হুঁশিয়ারিটি একটি পরীক্ষামূলক মহড়া? যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া যাচাই করাই এর উদ্দেশ্য? বেইজিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্যের পর রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যকে অনিচ্ছাকৃত ভাবার কোনো অবকাশ আছে কি? অবশ্য কারণ যা–ই হোক, প্রচ্ছন্ন বা প্রত্যক্ষ কোনো হুঁশিয়ারিই বন্ধুত্বের জন্য সহায়ক নয়।
●কামাল আহমেদ সাংবাদিক