চীন কি তার ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া করল

অল্প কিছুদিন আগেও চীন নির্ভুলভাবে তার শক্তিমত্তা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আধিপত্যের ভাবমূর্তির জায়গা দখল করার চেষ্টা করছিল। চীনের নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের চালু করা বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কোণঠাসা করার আয়োজন করে ফেলেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, চীনের সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। 

সাফল্যের জন্য যা যা দরকার, মনে হচ্ছিল তার সবই চীনের ঝুলিতে আছে। ১৯৪৫ সালের পর ইউএস মার্শাল প্ল্যান নামের যে অর্থব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থার জায়গায় নিজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্থাপন করার উদ্দেশে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামের একটি আন্তজাতীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ প্রকল্প শুরু করেছে। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে নিজের রেনমিনবিকে চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া চীন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বে আসতে চাচ্ছে। সে বর্তমানে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে আছে। দেশটি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফে তার কণ্ঠ উচ্চকিত করার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কোথাও বাধাগ্রস্ত হলে দেশটি নিজের মতো করে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো নিজস্ব কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। কোভিড-১৯ চীনকে তার সমস্ত কৌশল বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিয়েছিল।

অন্য যেকোনো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সর্বোচ্চ মেয়াদে পরিশোধযোগ্য ঋণ দিয়ে থাকে। এই কোভিড মহামারির মধ্যে কিস্তির অর্থ পরিশোধের বিষয়টি তারা স্থগিত রাখতে পারত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা আবার কিস্তির অর্থ নেওয়া শুরু করতে পারত।

অর্থনীতিবিদ স্ট মরিস ও তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক কিংবা আইডিএর মতো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে যে ধরনের শর্ত মানতে হয়, তার চেয়ে অনেক কঠিন শর্ত মেনে এবং অনেক বেশি চড়া সুদ দিয়ে চীনের কাছ থেকে ঋণ পাওয়া যায়।

চীন এসব শর্ত এ সময় কিছুটা শিথিল করতে পারত। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শর্তহীন স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিতে পারত। করোনায় আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত গরিব দেশগুলোকে বিনা শুল্কে তাদের বাজারে ঢোকার সুযোগ দিতে পারত। কোভিড-সংক্রমিত দেশগুলোকে চীন ফেস মাস্ক, টেস্টিং কিট, সুরক্ষা সরঞ্জাম, ভেন্টিলেটর—এসব স্বাস্থ্য উপকরণ সরবরাহ করতে পারত। বিশেষ করে তারা কম দামে এগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে সরবরাহ করার ঘোষণা দিতে পারত। 

এই ধরনের সহযোগিতামূলক উদ্যোগ নিলে সবাই বুঝত, যুক্তরাষ্ট্র যেসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব চীনও দিতে পারে। কিন্তু এসবের কিছুই না করে চীন উল্টো এমন কিছু কাজ করেছে, যা চীনের বৈশ্বিক লক্ষ্যকে আরও খাটো করে দিয়েছে। চীন যেসব জায়গায় প্রাধান্য বিস্তার করে আছে, সেগুলো মোটামুটি সবারই জানা। 

জিনজিয়াং, তিব্বত, তাইওয়ান, হংকংয়ে সে তার খবরদারি আরও কঠোর করেছে। যৌক্তিক সময়ের আগেই সে ভারত, দক্ষিণ চীন সাগর, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে তার আধিপত্যের লক্ষ্যবস্তুর তালিকায় রেখেছে। কোভিড-১৯–এর আদি উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়ার আন্তর্জাতিক চেষ্টাকে চীনের রুখে দেওয়ার চেষ্টাও সবাই প্রত্যক্ষ করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বের অভিভাবকত্ব নিজের দিকে নেওয়ার জন্য চীনের যখন আরও উদার হয়ে কাজ করার কথা, তখন সে কেন আগ্রাসী হয়ে উঠছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, চীন মনে করছে, আমেরিকা খুব শিগগির সবকিছু থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে এবং সেই শূন্যতা দখল করার জন্য আগেভাগেই আধিপত্যমূলক মনোভাব সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হবে। 

চীন যদি সেটা ভেবেও থাকে, তাহলে তাদের অর্থনীতির মহান সংস্কারক দেং জিয়াওপিং যেমনটা বলেছিলেন, সেভাবেই চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের সেই মাত্রায় দুর্বল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

তার আগেই চীন যেভাবে শক্তি প্রদর্শনের দিকে মনোযোগী হচ্ছে, তাতে তার গ্রহণযোগ্যতা ঝুঁকির মুখে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ চলার কারণে ইতিমধ্যেই চীন বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের টেলিপ্রযুক্তি হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করায় চাপে পড়েছে এই কোম্পানি।

হংকংকে যুক্তরাজ্য চীনের হাতে তুলে দেওয়ার সময় যে চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তির শর্তের বিরুদ্ধে গিয়ে চীন হংকংয়ের বিশেষ মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে একটি জাতীয় নিরাপত্তা আইন বানিয়েছে। যুক্তরাজ্যে ৫–জি নেটওয়ার্ক তৈরিতে হুয়াওয়ের কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু হংকং নিয়ে চীন নতুন আইন করায় সেই ফরমাশ বাতিল করেছে যুক্তরাজ্য। অন্যদিকে ভারতও লাদাখ–কাণ্ডে খেপে আছে। 

সব মিলিয়ে চীন যথেষ্ট চাপে পড়েছে। এই চাপ থেকে তার পক্ষে কত তাড়াতাড়ি বের হওয়া সম্ভব হবে, তার ওপরই বৈশ্বিক নেতৃত্ব কার হাতে যাবে, সেটা নির্ভর করছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

অরবিন্দ সুব্রামানিয়াম ভারত সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। বর্তমানে তিনি হরিয়ানার অশোক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন