পৃথিবীর চোখ ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে। আমেরিকান ভোটারদের বড় অংশই তাঁকে পছন্দ না করা সত্ত্বেও যিনি তাঁদের প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রতিবাদের মুখে পড়েছেন। কেমন করে তাঁর চোখ হাসছে, কেমন করে আঁচড়ানো তাঁর ঢেউখেলানো চুল, তিনি কেমনভাবে সাংবাদিকদের বসে যেতে বলছেন, কীভাবে কথা বলছেন—এসব নিয়েই পৃথিবী অস্থির। বাংলাদেশের লেখকেরা ব্যস্ত বইমেলা নিয়ে, কৃষকেরা মাঠে। যাদের দোকান পুড়ে গেছে, তারা ভাবছে কীভাবে সংসার চলবে। জটলা রোজ দেখি, ভেবে পাই না উত্তর। রাজনীতিকেরা মাঠে নামবেন কি না ভাবছেন। নতুনেরা নিরুৎসাহী: কী হবে মাঠে নেমে, যেখানে ফুটবলের গোল আগে থেকেই নির্ধারিত? উন্নতির ধাপ নির্ধারিতের চেয়েও বেশি, কাগজে কাগজে তা-ই লিখছে। আমরা মঙ্গল গ্রহের দিকে উঠে যাচ্ছি। দেখছি বিদেশি সিরিয়াল, পড়ি না কাগজের সম্পাদকীয়, ব্যবসায়ীরা গালে হাত দিয়ে বসে আছেন, কী করে চলবে ব্যবসা?
আমি ভাবছি, আমার একটি কলামেই আমি পৃথিবী উল্টে দেব। সবাই অবাক হয়ে ভাববে, কেমন করে শান্ত হয়ে গেল অশান্ত পৃথিবী, কেমন করে নেমে এল স্বর্গীয় প্রশান্তি সবার চোখেমুখে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে পড়তে আজ ভাবলাম সত্যি আমি নিজেই পৃথিবীতে আনতে পারি অনাবিল শান্তির আকাশ। যদি আমি নিজে শান্ত হই। আমাকে নিয়েই পৃথিবী। আমার চোখেই পৃথিবীর সৌন্দর্য। তাহলে সুন্দর হব না কেন? যেদিকে ঝড়, সেদিকে আকাশ কালো হবেই, যদি জানি যে ঝড় থেমে যাবে, আবার নীল হবে আকাশ। আমার এই নির্মল চিন্তাটুকুই আনবে নির্মল আকাশ। আমি দুর্যোগের দিনেও তাকিয়ে থাকব বসন্ত অভিমুখে।
তাই আমি বসন্তের গান গাই। তাই আজ হলুদ পাঞ্জাবি পরেছি। সুন্দর করে নিজের দিকে তাকিয়েছি। আমি বাইশ বছরের তরুণ। অন্তরই আমার বসন্তের নিয়ামক। কেন আমি সুন্দর হব না? কেন আমি বসন্তকে আহ্বান করব না? গতকাল গিয়েছিলাম ঢাকা থেকে বাইরে। খানিকটা গ্রামের খোঁজে। রাস্তায় তিন ঘণ্টা। রাস্তা অবরোধ। প্রথমে বিরুদ্ধ চিন্তাটাই মনটাকে গ্রাস করল। তারপর আমার আই প্যাডে চলে গেলাম এক প্রাণের ঔপন্যাসিকের কাছে। তিন ঘণ্টা মনে হলো তিন মিনিট। বিভূতিভূষণের সঙ্গে, চলে গেলাম তাঁর অরণ্যে, তাঁর নিজভূম ‘আরণ্যক’-এ। এমন তাঁর ক্ষমতা। ক্ষমতাটুকু আমরা বিস্মৃত হই। মনে পড়ে বনফুলের লেখা ‘পাঠকের মৃত্যু’। এক রেলস্টেশনে বসে বনফুল পড়ছেন একটি উপন্যাস। তিন ঘণ্টা চলে গেল তিন মিনিটে। পরে ওই লেখকের লেখা আর তাঁকে টানেনি।
যদি এভাবে জীবনটাকে দেখি, দুঃখের মুহূর্তগুলো মনে হবে এক মিনিটের। সুখের মুহূর্ত সারা দিন। রোজ সকালে সূর্য দেখি। তাই মনটা সারা দিন রঙিন। ব্রেক ফাস্টের জন্য বানানো আটার রুটিটি পুড়ে গেলেও রাঁধুনিকে বকি না। ভাবি তার দুঃখের জীবনের কথা। সে তো রাজরানিও হতে পারত। অথচ ভাগ্য তাকে টেনে এনেছে আমার বাড়ির রাঁধুনি করে। হাফবয়েল ডিমটি পুরোপুরি সেদ্ধ হয়ে গেছে, তার জন্য সে বকা খায়নি। এ জন্য যে আমি ক্ষমার রাজ্যে প্রবেশ করেছি। ক্ষমা সে কত সুন্দর, তা শিখেছি সূর্যের কাছে। সূর্য জানে না কোনো ভেদাভেদ। সে সবাইকে আলো দেয়। কাউকে বঞ্চিত করে না। সে উদার।
বসন্ত-দিনে কেন রঙিন হব না? কেন সবার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টি দেব না? আজকের বসন্ত জীবনের শেষ বসন্ত হতে পারে। তাতে কী? আমার জন্য অপেক্ষা করছে অন্য পৃথিবীতে চির বসন্ত। দুই বছর ধরে সেই মহাগ্রন্থটির অনুবাদ করেছি, যার পাতায় পাতায় এত সৌন্দর্যের বর্ণনা, যা কোনো লেখকের দৃষ্টির মাঝেই নেই।
অবর্ণনীয় সেই সৌন্দর্য রাশি। শুধু নদী নয়, আছে সেখানে পাল তোলা ময়ূরপঙ্খী নৌকা, যেখানে যথেচ্ছ উদার কণ্ঠে গাইতে পারি যেকোনো গান। যদি হয় রবিঠাকুরের ভালোবাসার গান, তা আমি শোনাব এমন প্রিয়াকে, যাকে কোনো দিন দেখিনি, অথবা আমার প্রিয়াই নতুন বেশে এসেছে, যে সবচেয়ে প্রিয়তমাদের মধ্যেও প্রিয়তম, গাইব আমার অন্তরের ভাটিয়ালি যে গান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গান, যা বিরহে পরিপূর্ণ। কেন আমার সকাল সুন্দর হবে না, যদি সে সকালে থাকে সেই বিরহের সুরটুকু?
আমি বসন্তের কবি। আমি বসন্তে বসন্তে সব তরুণের সঙ্গে মিশে যেতে পারব। তাদের তারুণ্য আমার রক্তে। তাদের সবগুলো বই কিনে পড়ব। প্রতিটি পঙ্ক্তির সঙ্গে একাত্ম হব। সবার সঙ্গে মিশব। বসন্ত তা-ই বলে গেছে। পৃথিবী একদিকে, আর বসন্ত অন্যদিকে। বসন্তের প্রতি আমার এত অনুরাগ। কোকিল ডাকেনি, তাতে কী? আমার মনেই কোকিল ডাকছে। নিজেই গান গাইছি। কোকিল না হলেও চলবে।
গ্রামের নানা প্রান্তে যে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, ফুটনোন্মুখ—তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। ছবি তুলব না, মনেই সে ছবি আঁকা হয়ে রইল। যেখানে যেতে চাই, সেখানে কি কৃষ্ণচূড়া আছে? উত্তর পেলাম: আছে, এর চেয়েও বেশি আছে, যে চূড়া তুমি আঁকতে পারো না, তার চেয়েও বেশি আছে। তোমার কল্পনার রঙের বাক্সে সবগুলো রং যেখানে শেষ, সেখানে আমার রঙের শুরু। আমি এত সুন্দর, আমিই চির বসন্ত, আমার কাছে এসো, আমি অপেক্ষায়। চির প্রার্থনায় আমি, কবে যাব সে দেশে?
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।