৮ মে টেলিভিশন সংবাদে দেখলাম, বাংলাদেশ থেকে ১০-১৫ লাখ টন চাল বিদেশে রপ্তানি করার ব্যাপারে সরকার চিন্তাভাবনা করছে বলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানালেন। খবরটায় খুশি হওয়ার কথা হলেও এক অজানা আশঙ্কা মনে এল। খুশি এ জন্য যে আমাদের দেশের কৃষকেরা খাদ্যশস্য উৎপাদনে এতটা সাফল্য অর্জন করেছেন যে এখন আমরা উদ্বৃত্ত চাল রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার উষালগ্নে দেশটা ‘একটা তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ হতে যাচ্ছে বলে মার্কিন নীতিপ্রণেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ওই সময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যে দেড় কোটি টন চাল প্রয়োজন হতো, তার মধ্যে আমরা উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। বাকি ৪০ লাখ টন খাদ্যশস্য জোগাড় করার জন্য আমাদের অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছে ভিক্ষার হাত পাততে হতো। কারণ, ওই ঘাটতি পূরণের জন্য খাদ্যশস্য আমদানির সামর্থ্য আমাদের ছিল না, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ছিল খুবই অকিঞ্চিৎকর।
সেখান থেকে গত ৪৮ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ১৭ কোটিতে পৌঁছেছে, চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে গেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। কিন্তু শস্য উৎপাদনের জমির বারবার ব্যবহার বাড়িয়ে, সেচযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়িয়ে, উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে ফলন বাড়িয়ে এবং কৃষকদের কাছে সার, সেচ, পানি, বালাইনাশক সহজলভ্য করে কৃষিতে বিপ্লব সাধনের ফলে ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে শুধু স্বয়ম্ভরতা অর্জন নয়, এখন খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালে দেশে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন ধান, ৩০ লাখ টন ভুট্টা, ১৫ লাখ টন গমসহ ৪ কোটি ১৩ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে বলে কৃষিমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন। এর সঙ্গে আরও ১ কোটি ৫ লাখ টন আলু উৎপাদন করে প্রায় ৩০ লাখ টন উদ্বৃত্ত পাবেন আমাদের কৃষকেরা। ফলে উদ্বৃত্ত চাল ও আলু রপ্তানির আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম পেতে সহায়তা করার তাগিদে। পত্রপত্রিকায় ইতিমধ্যে খবর বেরোচ্ছে, এবার ধানের দাম কম, ধানচাষিরা ক্ষুব্ধ। এখন সারা দেশ থেকে দ্রুত তথ্য সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয়ে রপ্তানি বিষয়ে একটা নিতে হবে সরকারকে। নীতিপ্রণেতাদের বিবেচনার জন্য কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি।
দেশের চালের বাজারে বেশ কয়েকটি বড় অটোমেটিক রাইস মিলের মালিকদের একটা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে ফেলেছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। গত বছর তারা যোগসাজশকারী ওলিগোপলি (collusive oligopoly) সৃষ্টি করে চালের দাম কয়েক মাস ধরে কৃত্রিমভাবে বেশ খানিকটা বাড়াতে পেরেছিল। উৎপাদন ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে চাল আমদানি অনেক কম হওয়ায় মুনাফাবাজির উদ্দেশ্যে বাজারে তাদের একধরনের কার্টেল পাওয়ার খাটাতে সমর্থ হয়েছিল তারা। এই মালিকদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ওই পর্যায়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের চেষ্টা থাকতে পারে বলে ওয়াকিবহাল মহলে এবং মিডিয়ায় আলোচনা হয়েছিল। বড় চালকল মালিকদের ওই সিন্ডিকেট কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এর সঙ্গে দেশের চালের বাজারের বড় মোকামগুলোর বৃহৎ আড়তদারদের যোগসূত্রকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। মুনাফাবাজির সুযোগ সৃষ্টি হলে এরা সংঘবদ্ধ মজুতদারির মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা চালের বাজারে দাম বাড়াতে পারে। সামনে যেহেতু বর্ষাকাল, তাই বন্যার আশঙ্কা দেখা দিলে উল্লেখিত সিন্ডিকেট ও মজুতদারদের গোপন সমঝোতা চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করতে পারে। ১০-১৫ লাখ টন চাল দেশের চালের বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য শতাংশ হওয়ায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের হাতে এই পরিমাণ জোগানের ঘাটতি বড়সড় অস্ত্র তুলে দেবে কি না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ১০-১৫ লাখ টন চাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ খুব বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে না, কিন্তু কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চালের বাজার বর্ষাকালে অস্থিতিশীল হলে অন্যান্য পণ্যের দামেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
এটা ঠিক যে চাল রপ্তানির একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। চাল রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় নাম উঠলে ‘তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ ইমেজ কাটানোর আরও একটি মাত্রা সৃষ্টি হবে। কিন্তু এখন কোনো নির্বাচন বা অন্য ধরনের রাজনৈতিক তাগিদ নেই চাল রপ্তানির রাজনৈতিক ফায়দা তোলার। অতএব, সিদ্ধান্তটি নিতে হবে মাঠপর্যায়ের কৃষকদের ন্যায্য দাম পাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে। রপ্তানি না করেও যদি সরকার ন্যায্য দামে বাজার থেকে বেশ কিছু পরিমাণ বোরো ধান সংগ্রহ করে সরকারের বাফার স্টক জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ওই ধানের চাল শহরের পোশাকশ্রমিক এবং গ্রামের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে ভর্তুকি দামে বিক্রি করে সরকার রাজনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হবে বলে আমার বিশ্বাস। তাহলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কোনো সুযোগ পাবে না কোনো সিন্ডিকেট বা মজুতদার গোষ্ঠী।
আমার এই প্রস্তাবের একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য রয়েছে। ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক রাজ্যে সফলভাবে খাদ্যশস্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে শরিক হয়ে বিংশ শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে আমরা রেশনিং ব্যবস্থাকে প্রায় গুটিয়ে ফেলেছি। এর পরিবর্তে ভিজিডি ও ভিজিএফের মতো যে কয়েকটি সেফটি নেট কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলোর প্রকৃত ফায়দাভোগী ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান-মেম্বার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও আমলা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রেশনিং ব্যবস্থাও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। তবু বলব, সমাজের বিত্তহীন ও দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বাজারব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। বাজারব্যবস্থার পাশাপাশি শহরের ও গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ভর্তুকি দামে খাদ্যশস্য পৌঁছানোর একটা ‘কার্যকর সিস্টেম’ সরকারের রুটিন দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা এখনো অগ্রাধিকারের দাবি রাখে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির টানে ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় দেশের খাদ্য মজুত বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমেছিল। আরেকটু হলে বাংলাদেশ ২০০৭ সালে আবার দুর্ভিক্ষাবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল, এটা আমরা ডেন ভুলে না যাই। ২০০৬ সালে সরকারের খাদ্যশস্যের বাফার স্টকের নাজুক অবস্থা ২০০৭ সালের শেষ দিকে চালের বাজারে যে কৃত্রিম সংকট এবং বিপজ্জনক ‘প্যানিক বাইয়িং’ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, সেটার পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়। ওই সময় সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন থাকায় মজুতদারেরা কিছুটা ভয়ে ছিল, তাই পরিস্থিতি কোনোমতে সামাল দেওয়া গেছে।
ভবিষ্যতে এ রকম অজুহাত পেলে সরকার ও জনগণকে বিপদে ফেলবে মজুতদারেরা। আমরা ১৯৭৪ সালের কথা যেন বিস্মৃত না হই। চালের দাম আড়াই টাকা কেজি থেকে দুই মাসের মধ্যে ১০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিল এ দেশের মজুতদারেরা। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পেছনে চালের এই অতিদ্রুত আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতিকেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যের ওপর ক্রয়ক্ষমতা হারানোর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, ১৯৭৩ সালের তুলনায় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপাদন প্রকৃতপক্ষে বেড়ে গিয়েছিল। তাই উৎপাদন ঘাটতির জন্য দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, সেটা পুরোপুরি ঠিক নয়। বর্ষাকালে এখনো এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মৌসুমি বেকারত্বের শিকার হয়, এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। আমি রপ্তানির বিপক্ষে বলছি অতীতের এই দুঃখজনক কাহিনিগুলোকে স্মরণ করে।
ড. মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক