একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একতরফা সংসদ চার বছর পার করল। এর চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আমাদের উদ্বিগ্ন করে। প্রথমত, কোরাম সংকট নিয়ে সংসদ চলছে। এটা নিশ্চিত করে যে সাংসদেরা সংসদবহির্ভূত অন্য কাজে বেশি ব্যস্ত। যদিও ওই সময়ে তাঁরা সংসদ চত্বরে বা ঢাকায় থাকেন, কিন্তু সংসদের কাজে সময় দিতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, সংসদীয় কার্যপ্রণালির ৬৮ ও ১৪৭ বিধি অনুযায়ী জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে সংসদে প্রস্তাব পাস করতে পারে, কিন্তু এর আওতায় ধন্যবাদ বা প্রশংসাসূচক প্রস্তাব পাসের প্রবণতা। এমনকি এসব ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চার ঘণ্টা গড়িয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। তৃতীয়ত, বিল পাসে কম সময় লাগা। গড়ে ৩০ মিনিটে বিল পাস হয়েছে। চতুর্থত, সরকারের বিল বা কোনো নীতির প্রশ্নে পক্ষে-বিপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা দেখা যাবে। এ ছাড়া আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে কারণে-অকারণে সংসদীয় কমিটির বিদেশ সফর এবং মন্ত্রীদের সংসদ অধিবেশনে কম হাজির থাকা।
সুতরাং এই সংসদের কাছে বাকি এক বছরে আর তেমন কিছু আশাব্যঞ্জক চাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ থাকতে পারে না। ওই ধারাই চলবে ধরে নেওয়া যায়। অবশ্য আমরা মনোবল হারাতে চাই না। কারণ গণতন্ত্র হলো চর্চার বিষয়। ব্রিটেনের কয়েক শ বছর লেগেছে, আর আমাদের এখনো অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হয়নি। কারও মতে, আমরা শৈশবকাল পার করছি। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদ বলেছেন, তাঁরা একটি নবযুগের সূচনা করেছেন। প্রতিবাদ হবে ওয়াকআউটে, তাই বলে সংসদ বর্জন? নৈব নৈব চ।
গত চার বছরে সাংসদেরা সরকারি বিল পাসে নবম সংসদের চেয়ে কম সময় দিয়েছেন। এবার তাঁরা গড়ে ৩০ মিনিট সময় ব্যয় করেছেন। অনেক বিল ১৫ মিনিটেও পাস হয়েছে। ২০০৮ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতেও ৪০ ভাগ বিল এক ঘণ্টার মধ্যে পাস হয়। কিন্তু সেখানকার সংসদীয় কমিটিতে আইন তৈরির প্রক্রিয়া যতটা দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন হয়, সেটা এখানে হয় কি? পঞ্চম সংসদে সংসদীয় কমিটিকে সংসদ থেকে আলাদা করা যেত। কারণ, কমিটিতে বিরোধী দলের একটা সংখ্যাগত প্রাধান্য ছিল। আর বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টির ৮ মহিলা সংসদ নিয়ে ৩৯। সংসদীয় কমিটির সংখ্যাই ৩৯। সুতরাং সংসদ যাঁরা গঠন করেছেন, তাঁরা সংসদীয় কমিটিকে কার্যকর করার চিন্তা করছেন বলে মনে হয় না। তাঁরা হয়তো ভাবেননি, দেশ চালাতে কিছু কাজ তো করাতে হবে। আর সে জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে নজরদারি করতে প্রতি কমিটিতে বিরোধী দলের অন্তত দুজন সাংসদ আনতে চাইলেও প্রায় ৮০ জন সাংসদ লাগার কথা। ৩৯টি কমিটিতে তাই বিরোধী দলের দুজন করেও রাখা যায়নি।
অবশ্য বিরোধী দলের রাখলেই বা কী হতো? কারণ, সরকারের প্রশংসায় সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের দলটি কখনো সরকারি দলকেও লজ্জা দিচ্ছে। সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের স্বল্পতা কোন পর্যায়ের সংকট তৈরি করতে পারে, তার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এই সংসদ। সংসদে শক্তিমান বিরোধী দল না থাকলে সংসদীয় কমিটিগুলোকে কোনোভাবেই তেমন কার্যকর করা যায় না।
সংসদকে আইনের গুণগত মান দিয়ে চেনা উচিত। যেহেতু সংসদীয় কমিটিগুলোই আইন তৈরির চূড়ান্ত কাজটা করছে। তাই খোঁজ নিলাম, এর প্রক্রিয়া কীভাবে চলে। জানলাম, সাকল্যে ১০ জনের টিম থাকলেও দীর্ঘদিন পাঁচটি পদ শূন্য। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের একটি লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইং আছে। কিন্তু এর দক্ষতা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে, এর সপক্ষে আমরা কোনো প্রমাণ পাই না। এই ঘাটতি পূরণে সংসদের লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইং শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে খোলা হয়েছিল। রোববার একটি নতুন তথ্য জেনে সন্দিগ্ধ হলাম। এটি সত্যি হলে বলব, এটা ক্ষমতার পৃথক্করণের নীতি সমর্থন করে না। দক্ষতার ঘাটতি পড়লে সেটা এভাবে পূরণ করা সমীচীন হতে পারে না।
জানলাম, সংসদে যেসব বিল প্রথমে উঠছে, তাতে অনেক ভুলত্রুটি দেখা যায়। মন্ত্রিসভা বিভাগ যত্নশীল হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে আইনের খসড়া তদারককারী মন্ত্রিসভা বিভাগের একটি সাব-কমিটিতে সংসদের একজন প্রতিনিধিকেও অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। জানা গেছে, গত বছরই এটা প্রথম চালু করা হয়েছে। আইন শুদ্ধ করার উপলব্ধি ভালো। কিন্তু তা করার উপায় ঠিক নয়। অবশ্য রূঢ় ও অপ্রিয় সত্য হলো, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গের সঙ্গে সংসদের যে চিরাচরিত দূরত্ব বা বিরোধ, তা যে ঘুচে গিয়েছে, সেটা এই ঘটনাতেও স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। সরকার সংসদে বিল পাসের কোনো প্রস্তাব করার আগে সংসদীয় সচিবালয় এ রকম প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে না। সরকার ও সংসদের স্বাধীন পরিচয় অটুট রাখতে হবে।
এটা লক্ষণীয় যে গত চার বছরে এই সংসদ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের মতো অল্প কিছু মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করেছে। সুশাসন ও আইনের শাসনসংক্রান্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত কোনো আইন, যেমন ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধির মতো কোনো কিছুতে তারা হাত দেয়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুমের মতো বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের ওপর কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা কোনো বিল আনেনি। সংসদের ফ্লোরে নির্বাহী বিভাগের কোনো দুর্নীতির বিষয়ে ‘প্রাণবন্ত’ কোনো বিতর্ক হয়নি, তবে উন্নয়নের গুণকীর্তনেই সংসদকক্ষ মুখর ছিল।
সংসদের মতো একটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বৈধতার প্রশ্নে কোনো একটিমাত্র নির্দিষ্ট রূপকল্প হতে পারে না। আইনিভাবে বৈধ হলেও তা রাজনৈতিকভাবে অবৈধ হতে পারে। আবার কোনো সংসদ আইনি ও রাজনৈতিক উভয় অর্থে অবৈধ হতে পারে। সামরিক বা আধা সামরিক শাসনামলের সংসদগুলোর বৈধতার প্রশ্ন তার উদাহরণ। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদকে আমরা রাবার স্ট্যাম্প বলি। কিন্তু ভোটারযুক্ত নির্বাচনও রাবার স্ট্যাম্প হতে পারে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন হওয়ার পর চলতি সংসদের বৈধতার প্রশ্ন আলোচিত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে দেখলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। সরকারি দলের এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় যে যেহেতু একটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হতে পারে, তাই সরকার গঠনের জন্য যে ১৫১টি আসন দরকার, তার থেকেও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারে, আর তা সাংবিধানিকভাবে শুদ্ধ।
বর্তমান সংসদ সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদে বলেছে, যাঁরা ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন বা ডাইরেক্ট ইলেকশনের’ মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন, তাঁরাই সংসদ সদস্য বলে অভিহিত হবেন। ১৫৪ জন প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত হননি। আমরা বলেছিলাম, এ রকম কাগুজে বৈধতা ভূতাপেক্ষভাবেও মীমাংসা করা চলে। তাই বর্তমান সংসদের বৈধতার বিষয়টি আসলে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। এই লেখার শুরুতে গত চার বছরের যে চারটি বৈশিষ্ট্য আমরা চিহ্নিত করলাম, সেটাই আমাদের বিবেচনায় আইনগত, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও মানুষের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আগেও ওই সমস্যা ছিল, নিরঙ্কুশ শাসন তা আরও নিরঙ্কুশ করেছে। এর থেকে বেরোতে চাইলে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই সব থেকে বেশি ভরসা দিতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]