মানুষের চন্দ্র বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি হলো চলতি মাসে। অ্যাপোলো-১১ নামের মার্কিন মহাকাশযানে চেপে নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই ঘটেছিল এই অভূতপূর্ব ঘটনা।
তখন ছিল না আজকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোন কিংবা অসংখ্য স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল। বেতারে কান পেতে কিংবা জাতীয় টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে উন্মুখ অপেক্ষায় ছিল সবাই, কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, কখন চাঁদে পা রাখবেন নীল আর্মস্ট্রং! লুনার মডিউল ঈগল থেকে মই বেয়ে চাঁদের বুকে যখন নীল আর্মস্ট্রং পা রাখলেন, সেকি উচ্ছ্বাস চারদিক! অবশেষে কল্পলোকের চাঁদের মাটি স্পর্শ করল মর্ত্যের মানুষ।
চাঁদে পা রেখে অভিভূত নীল আর্মস্ট্রং উচ্চারণ করলেন সেই কিংবদন্তি উদ্ধৃতি, ‘একজন মানুষের এই ছোট পদক্ষেপ, মানব জাতির জন্য এক বিরাট অগ্রযাত্রা।’ এই প্রথম কোনো ইস্যুতে পুরো মানবজাতিকে এককাট্টা হয়ে উল্লাসে মেতে উঠতে দেখল বিশ্ব। তাই এই বিজয়কে আমেরিকার একক বিজয় হিসেবে দেখলে ভুল হবে। মানব ইতিহাসের স্মরণীয় অধ্যায়ের যখন সূচনা হচ্ছিল, তখন আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। এই মহাকাশ যাত্রার খুঁটিনাটি বোঝার মতো বয়স যদিও ছিল না, তবে সাদা কালো টিভির পর্দায় নীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদের মাটিতে পা রাখার দৃশ্যটি স্মৃতিতে এখনো অম্লান।
উনিশ শতকের শুরু থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাধান্য পেয়েছে চাঁদ। চাঁদ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার আদিপুরুষ হলেন ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও। ১৬০৯ সালে নিজের উদ্ভাবিত টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি প্রথম চাঁদের পৃষ্ঠতল দেখতে পান। তবে মহাকাশ ও চাঁদ নিয়ে গবেষণায় আমেরিকার চেয়ে রাশিয়া ছিল বেশি এগিয়ে। মহাকাশে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ও মানুষ পাঠানোর কৃতিত্ব সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের। চাঁদে প্রথম অভিযানও শুরু করে রাশিয়া। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি লুনা-২ কৃত্রিম উপগ্রহ চন্দ্র পৃষ্ঠে অবতরণ করে। লুনা-২ হচ্ছে চাঁদে অবতরণকারী মনুষ্যনির্মিত প্রথম বস্তু। এরপর থেকেই বলতে গেলে চাঁদে মানুষ পাঠাতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে রাশিয়া ও আমেরিকা। তবে এই প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় আমেরিকা।
১৯৬১ সালের ২৫ মে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ষাট দশক শেষ হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে মানুষ পাঠাবে বলে ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্ট যখন চন্দ্রাভিযানের কথা বললেন, তখন মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীদের কাছে সেটা ছিল একবারে অসম্ভব। চাঁদে পাড়ি দেওয়ার জন্য বিশেষ কম্পিউটার, রকেট ও অন্যান্য কী কী লাগতে পারে সেটাও ছিল মানুষের অজানা। ১৯৬১ সালের মে থেকে ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ের মধ্যে হাজারো সমস্যার সমাধান করে সেই অসাধ্যসাধন করেছে নাসা। এই অভিযান সফল করতে অ্যাপোলো মিশন প্রজেক্টে পারমাণবিক বোমা বানানোর চেয় তিনগুণ বেশি মানুষ কাজ করেছিল।
১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই, নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে অ্যাপোলো-১১ রকেটে চেপে নীল আর্মস্ট্রংদের যাত্রা শুরু হয়। মিশন অধিনায়ক আর্মস্ট্রংয়ের সহযাত্রী ছিলেন মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন। যাত্রা শুরু হওয়ার ১২ মিনিটের মধ্যে রকেট পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে যায়, এবং শুরু হয় চাঁদের অভিমুখে মহাযাত্রা। তিন দিনের মাথায় ১৯ জুলাই অ্যাপোলো-১১ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। চন্দ্রযানের প্রথম অংশ কমান্ড মডিউল চাঁদের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে থাকে আর অপর অংশ লুনার মডিউল ২০ জুলাই চাঁদে অবতরণ করে। নভোচারীরা চাঁদের বুকে ছিলেন প্রায় সাড়ে একুশ ঘণ্টা। ২৪ জুলাই চন্দ্র বিজয়ীরা ফিরে আসেন পৃথিবীতে। এর মধ্য দিয়েই শেষ মানুষের প্রথম চন্দ্র অভিযান।
নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে নামার প্রায় ১৯ মিনিট পর তাঁর সহযাত্রী অলড্রিনও নেমে আসেন। নভোচারীরা চাঁদের বুকে তোলেন অসংখ্য ছবি, ব্যাগে পুরে নিয়ে নেন প্রায় ২২ কেজির মতো চাঁদের মাটি ও শিলা। জানা যায়, অ্যাপোলো-১১ যাত্রা করার তিনি দিন আগেই চাঁদে অনুসন্ধান চালানোর জন্য সোভিয়েত রাশিয়া পাঠিয়েছিল মানুষবিহীন রোবট যান লুনা-১৫। আমেরিকার আগে চাঁদের মাটির নমুনা পৃথিবীতে এনে বিশ্বকে চমক দিতে চেয়েছিল আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া। মার্কিন নভোচারীরা যখন চাঁদের মাটিতে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন, তখন লুনা-১৫ চাঁদের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করছিল। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা বহু চেষ্টা করেও লুনা-১৫ চাঁদে নামাতে পারেননি।
চাঁদের বুক নভোচারীরা রেখে আসেন কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, আমেরিকার পতাকা, পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের মানচিত্র এবং একটি ক্ষুদ্র সিলিকন মেসেজ ডিস্ক, যার মধ্যে রেকর্ড করা আছে পৃথিবীর ৭৩টি দেশের প্রধানসহ আমেরিকার কয়েক প্রেসিডেন্টের বাণী। দেড় ইঞ্চি ব্যাসের এই ডিস্ক এমন টেকসই করে তৈরি করা হয়েছে যে, তা হাজার বছরেরও বেশি চাঁদের বুকে টিকে থাকবে।
চাঁদে ভ্রমণকারী নভোচারীদের অনেকেই চাঁদে এলিয়েন বা বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব থাকার দাবি করছেন বলে জানা যায়। যদিও এর পক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, চাঁদের বুকে রেখে আসা স্মারকচিহৃগুলো একদিন উন্নতর কোনো সভ্যতার এলিয়েনদের চোখে পড়বে। তখন পৃথিবীর মানচিত্র দেখে তারা মানব জাতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে সচেষ্ট হবে।
চাঁদ যে গতিতে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, ঠিক সেই গতিতে নিজের অক্ষের ওপর ঘুরে বলে চাঁদের একটি পিঠই পৃথিবী থেকে আমরা দেখতে পাই, যা চাঁদের ভূপৃষ্ঠের ৫৯ শতাংশ। আমাদের দৃষ্টির অগোচরে রয়ে যাওয়া বাকি ৪১ শতাংশ অংশকে ডার্ক সাইড বলা হয়। মহাকাশ গবেষণায় প্রথমে কিছুটা অমনোযাগী থাকলেও, পৃথিবীর অন্য এক পরাশক্তি চীন আর পিছিয়ে থাকতে চায় না। এ বছরের শুরুতে ৩ জানুয়ারি চাঁদের যে অংশটি পৃথিবী থেকে দেখা যায় না, সেই দিকে মনুষ্যবিহীন রোবটযান চাঙ-আ ৪ নামিয়েছে চীন। এ ছাড়া ২০৩৬ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে চীন।
অপয়া অ্যাপোলো-১৩ বাদ দিয়ে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত মোট ছয়বার অ্যাপোলো মিশনের মাধ্যমে চাঁদের বুকে মানুষের পা পড়ে। কিন্তু সেই থেকে নাসা আর কোনো চন্দ্রাভিযান পরিচালনা করেনি। কিন্তু চীনের চাঁদে মানুষ পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে আমেরিকা ও নাসা। ষাট দশকের মতো একুশ শতকেও সবার আগে চাঁদে মানুষ পাঠানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে আমেরিকা। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা আবারও চাঁদে নভোচারী পাঠাবে বলে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও রাশিয়ার মিত্রদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শেষ হলেও সংঘাতে ভরা পৃথিবীতে দিকে দিকে এখন চলছে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা। পরাশক্তিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেতে আছে প্রক্সি যুদ্ধে। তবে আমেরিকার আবারও চাঁদে মানুষ পাঠানোর সংকল্প দেখে মনে হচ্ছে, ষাট দশকের মতো মহাকাশ-কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা আবার জমে উঠবে।
অ্যাপোলো-১১-এর চাঁদে অবতরণ বিশ শতকের সবচেয়ে সেরা অর্জন। দ্রুতগতির কম্পিউটার, মাইক্রোচিপ তৈরির মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ওই সময়। অ্যাপোলো মিশন একতাবদ্ধ করেছিলে পুরো মানবজাতিকে। তাই মহাকাশ গবেষণায় এ ধরনের প্রতিযোগিতা বিশ্বশান্তির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে বলেই মনে হচ্ছে।
(লেখক: নগর পরিকল্পনাবিদ ও জলবায়ু গবেষক)