২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

চলে গেলেন ভাষা-সেনাপতি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাংলাদেশে স্মৃতিচারণা খুবই কার্যকর ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণা করেই অনেকে ভাষাসৈনিক হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছেন।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত কার কী অবদান সে বিষয়টি গৌণ হয়ে গেছে। যদিও ভাষা আন্দোলনের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচিত হয়েছে, ফলে ওই আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতির কোনো চেষ্টাই আর সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম শাহাদাত বরণ না করলে আজ অনেক ভাষাসৈনিকের নাম আমরা জানতাম না।

কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারিতে রক্তপাত না হলেও বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে যাঁর নামটি উচ্চারিত হতোই তিনি আবদুল মতিন।

ভাষা আন্দোলনের কয়েকটি পর্যায়। মধ্যসাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সবগুলো পর্যায়েই তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি।
কোনো বড় কাজে কেউ ভোরবেলা যোগ দিয়ে সন্ধ্যায় শেষ হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকলেন, তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজটির শেষ মুহূর্তে দলবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করলেন, তাঁদের ভূমিকার তুলনা হয় না।

পূর্ব বাংলায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলনের আগে জনমত গঠনের কাজটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সেই কাজটির সূচনা করেন এবং নেতৃত্ব দেন তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল মতিন।


১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ডাক বিভাগের খাম, পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজির সঙ্গে উর্দু লেখা হয়।

তার প্রতিবাদ করেন প্রাদেশিক সচিবালয় ইডেন বিল্ডিংয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা।

তাঁদের সেই প্রতিবাদে সংহতি প্রকাশ করে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বের সূচনা করেন আবদুল মতিন। তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে একজন প্রচারকে পরিণত হন।


১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে প্রথম যাঁরা একটি সংগঠন গঠন করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ এবং আবদুল মতিন।


১৯৪৮-এর জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন জেলায় বাংলা ভাষার প্রশ্নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনমত গড়ে ওঠে। এর মধ্যে মার্চে ঢাকা সফরে আসেন গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ।

রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা যে স্বেচ্ছাচারী ঘোষণা দেন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায়, তা শুনে শ্রোতাদের মধ্য থেকে যাঁরা ‘নো নো’ ধ্বনি দেন আবদুল মতিন তাঁদের একজন।

তারপর ২৪ মার্চ কার্জন হলে জিন্নাহর সম্মানে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতার সময় জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর মত পুনর্ব্যক্ত করেন।

তৎক্ষণাৎ সেখানে ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ করেন জনা কয়েক ছাত্র। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মতিন ও এ কে এম আহসান।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন অসংখ্য মানুষ, সক্রিয় ভূমিকাও রেখেছেন অনেকে। তবে সাহসী ভূমিকা ও সাবধানি ভূমিকা এক নয়।

জিন্নাহর মুখের ওপর প্রতিবাদ করা যে তখন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা একালের মানুষ অনুমান করতে পারবে না। তা ছিল একেবারেই রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিষয়টি হয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনযাপনের অংশ—শুধু কোনো একটি দাবি আদায়ের ইস্যু নয়।

তাঁর সহপাঠী ও বন্ধুদের থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত তিনি একটি কালো চামড়ার হাতব্যাগ সব সময় বহন করতেন। তাতে থাকত রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক কাগজপত্র।

রাষ্ট্রভাষা নিয়ে অব্যাহত লেগে থাকায় তিনি অর্জন করেন একুশে ফেব্রুয়ারির অনেক আগেই একটি উপনাম: ভাষা-মতিন।
যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাঁর সূচনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে।

সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ভাষা-মতিন। তাঁর অবদানের বিচার করতে হবে সেভাবে, অসংখ্য ভাষাসৈনিকের একজন হিসেবে নয়।


ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই আর একটি তারিখ ১১ মার্চ। গণপরিষদের সরকারি ভাষা-তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া, পাকিস্তানি রুপি ও ডাকটিকিটে উর্দুর সঙ্গে বাংলা না থাকা এবং পাকিস্তানের অন্যতম ও পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণা দেওয়ার দাবিতে জাগ্রত যুবসমাজ ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়।

আগের রাত থেকেই যাঁরা পিকেটিংয়ে রাস্তায় থাকেন তাঁদের অগ্রভাগে ছিলেন আবদুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ। পুলিশি নিপীড়নের মধ্যেও অসাধারণ হরতাল পালিত হয় সারা দেশে।

পুলিশের হাতে আহত হয়েছিলেন ২০০ এবং আটক হয়েছিলেন ৯০০।
১৯৪৮-এ গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মতিন। এই কমিটি ভাষার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করত।

মোহাম্মদ সুলতান প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫৩) জানায়: ‘এই রাষ্ট্রভাষা কমিটিই প্রতি বৎসর ১১ই মার্চ “রাষ্ট্রভাষা দিবস” উদযাপন করত এবং এই কমিটিই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে প্রথম সংগঠিত রূপ দেয়।’ [পৃ. ১৬৬]

১৯৫২-এর ৩১ জানুয়ারি যে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় মওলানা ভাসানীকে আহ্বায়ক করে, আবদুল মতিন ছিলেন তার সবচেয়ে সক্রিয় সদস্যের একজন।

এই পরিষদের আহ্বানে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা নগরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।

ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা করেন। সভা শেষে বের হয় শোভাযাত্রা। ঢাকার ইতিহাসে বৃহত্তম সেই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন ‘৫ হাজার ছাত্রছাত্রী’। আবদুল মতিন ছিলেন মিছিলের মাথায়।

ওই দিনই ঘোষণা দেওয়া হয় ‘২১শে ফেব্রুয়ারী অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে সারা প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট’ পালিত হবে।

৫ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধর্মঘটের সপক্ষে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়।


তারপর জাতির জীবনে এল একুশে ফেব্রুয়ারি। সরকার জারি করে ১৪৪ ধারা। ‘বেলা ১২টার মধ্যে সকল স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে হাজির’ হন।

১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি হবে না, এই প্রশ্নে সভা। অনেকেই না ভাঙার পক্ষে মত দেন। ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক জনাব আবদুল মতিন আন্দোলনের পূর্বাপর পর্যায়ক্রম ও ১৪৪ ধারা প্রবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ সঙ্কটজনক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করলেন।’ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সপক্ষে ছাত্রদের অধিকাংশ মত দেন। ‘দশজনী মিছিল’ বের হয়। তার পরের ইতিহাস সবাই জানেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। কেউ গ্রেপ্তার হন, কেউ আত্মগোপন করেন।

‘৮ই মার্চ রাত্রে পুলিশ এক বাড়িতে হানা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ৯ জন আত্মগোপনকারী নেতাদের মধ্যে ৮ জনকে গ্রেফতার করে নেয়। তাদের মধ্যে জনাব অলি আহাদ, জনাব তোয়াহা, জনাব আবদুল মতিন প্রভৃতি ছিলেন।’ [একুশে ফেব্রুয়ারি, পৃ. ১৭৯]

শুধু ভাষা আন্দোলনের নেতা বললে আবদুল মতিনের পূর্ণ পরিচয় দেওয়া হয় না। ১৯৫১-এর মার্চে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হয়। তার সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী, সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মতিন ও মোহাম্মদ তোয়াহা।

যুবলীগ ছিল পূর্ব বাংলার প্রথম অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগঠন। মার্ক্সবাদী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। আমৃত্যু তিনি মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

১৯৫৮-এর জানুয়ারিতে রংপুর জেলার ফুলছড়িঘাটে এক বিশাল কৃষক সমাবেশে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি’, পাকিস্তানের বৃহত্তম কৃষক সংগঠন।

হাতেম আলী খান ছিলেন সম্পাদক এবং আবদুল মতিন যুগ্ম সম্পাদক। তিনি ছিলেন নিবেদিত কৃষকনেতা।
কৃষকদের সংগঠিত করে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এই প্রত্যয় তাঁর ছিল। তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, কিন্তু তাঁর উপায় নির্ভুল ছিল না।

১৯৬৮-৬৯-এ আমি মতিন-সালাউদ্দিনদের রাজনীতির অল্পকাল কর্মী ছিলাম।

তাঁদের নকশালী নীতিটি ভালো লাগেনি। তখন এবং স্বাধীনতার পরও বহুদিন ও বহুরাত আমরা একত্রে থেকেছি। নিজের ভুল তিনি স্বীকার করতে সংকোচ বোধ করতেন না।

তাঁর অধিকাংশ কপট, সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালোভী কমিউনিস্ট সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর কোনো তুলনা হয় না।


আদর্শের কারণে একসময় হত্যার রাজনীতিতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল না কারও প্রতি। তাঁর মতো স্নেহপ্রবণ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।

সব সময় আমার ছেলেমেয়ের খোঁজ নিতেন। ভালো খাওয়া পছন্দ করতেন, কিন্তু স্রেফ ডাল-ভাতও তাঁকে অতিতৃপ্তির সঙ্গে খেতে দেখেছি।

কয়েক বছর আগে বাইপাসের পর থেকে মাঝেমধ্যেই তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। শেষ দিনগুলোতে তাঁর চিকিৎসায় ত্রুটি হয়নি।

মেহগনি কাঠের মতো শক্ত ছিল তাঁর শরীর। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর খোঁজ রেখেছি।

উপাচার্য ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের কাছে তাঁর অবস্থা জেনেছি। তিনি তাঁর সব সময় খোঁজ রেখেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, মতিন সাহেব আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করেছেন। অসামান্য প্রাণশক্তি। ওষুধে কাজ করে। তবে—
ঈদের আগের সন্ধ্যায় মতিন ভাইকে তাঁর শেষশয্যায় শেষবার দেখি।

মুখে-নাকে যন্ত্র লাগানো। অতিকষ্টে তিনি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন। মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে শেষবার প্রশ্বাস নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন না।

মনিটরে দেখলাম রক্তচাপ নিচে নেমে যাচ্ছে। তাঁর চাদরে ঢাকা পা ছুঁয়ে বাইরে বেরিয়ে ভাবির সঙ্গে কথা হয়। লিফট পর্যন্ত ভাবি পৌঁছে দেন।

এমন মানুষের সংসার করে জীবনে অশেষ কষ্ট সহ্য করছেন। বললাম মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা ছাড়া আর আমাদের কী করার আছে।
চলে গেলেন আমাদের ভাষা-সেনাপতি।


সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷