আমরা জানতাম, দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের পর তৃতীয় পেরিয়ে আমরা পা ফেলেছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দরজায়। কিন্তু অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াব বলছেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিপ্লবের সুফল এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সব মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। তাঁর হিসাবে দ্বিতীয় বিপ্লব এখনো বিশ্বের ১৭ শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। কারণ, পৃথিবীর ১৩০ কোটি মানুষ এখনো বিদ্যুৎ পায়নি। তাঁর মতে, তৃতীয় বিপ্লবও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কাছেই অধরা, কারণ ৪০০ কোটি মানুষ এখনো ইন্টারনেট–সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অবশ্য এ কারণে সভ্যতার বিকাশে শিল্পবিপ্লবের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই।
শোয়াব ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগাম ফসল হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০ শতাংশ মানুষের পরিধেয় বস্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে ইন্টারনেট, ১০ শতাংশ মানুষের চশমার সঙ্গেও ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকবে, পাওয়া যাবে মানুষের শরীরে স্থাপনযোগ্য মোবাইল ফোন, ৯০ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করবে, আমেরিকায় ১০ শতাংশ গাড়ি হবে চালকবিহীন, ৩০ শতাংশ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অডিট হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অডিটর দিয়ে, এমনকি কোম্পানির বোর্ডের এক পরিচালক হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট, আমেরিকায় এসে যাবে রোবট ফার্মাসিস্ট। এ ধরনের আরও বহু অবিশ্বাস্য উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের কথা আছে এ তালিকায়।
প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে বিদ্যুৎশক্তি ও প্রযুক্তির উত্কর্ষ কাজে লাগিয়ে বর্ধিত উৎপাদন নিশ্চিত করে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের চালিকাশক্তি ছিল পারমাণবিক শক্তি, টেলিযোগাযোগ, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে প্রযুক্তির সঙ্গে জৈব অস্তিত্বের সংমিশ্রণে এক নতুন সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে। ইতিমধ্যে রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট, ন্যানো প্রযুক্তি যে অভাবনীয় পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তাতে এই বিপ্লবের ব্যাপ্তি ও প্রভাব সম্পর্কে ধারণা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৬ সালের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার কিছু চমকপ্রদ তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন ইউটিউব দেখা হয় দৈনিক ৮৮০ কোটি বার, ই–মেইল পাঠানো হয় ২০ হাজার ৭০০ কোটি, আর গুগল সার্চের সংখ্যা ৪২০ কোটি। এটি বদলে যাওয়া পৃথিবীর জীবনযাপনের চলমান চিত্রমাত্র। এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, সমাজ, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদির ওপর যে বিশাল প্রভাব পড়বে, তার একটা পর্যালোচনা করেছেন ক্লাউস শোয়াব তাঁর দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন গ্রন্থে। এই নতুন শিল্পবিপ্লবের পক্ষে–বিপক্ষে পরস্পরবিরোধী মতও রয়েছে। সবচেয়ে বড় মতটি কর্মসংস্থানবিষয়ক। শ্রমের ওপর পুঁজির প্রাধান্যের কারণে শ্রমনির্ভর উৎপাদনপ্রক্রিয়ার বিপরীতমুখী যাত্রার কথা পুরোপুরি অস্বীকার না করেও শোয়াব মনে করেন, এর ফলে মানুষ অপেক্ষাকৃত স্বল্প ব্যয়ে বেশি ভোগ করতে পারবে।
শোয়াব দেখিয়েছেন, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার আগে বিশ্ব অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশ। এই হার বজায় রাখতে পারলে প্রতি ১৪ থেকে ১৫ বছরে জিডিপি দ্বিগুণ হতে পারত, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ উঠে আসতে পারত দারিদ্র্যরেখার ওপর। অনেকের আশা ছিল, এই মন্দার ধকল কাটার পর প্রবৃদ্ধির হার আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটেনি। শোয়াব এর দুটি কারণ দেখিয়েছেন: বার্ধক্য ও উৎপাদনশীলতা, দুটোই প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত।
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৮০০ কোটি। পরের ২০ বছরে বাড়বে আরও ১০০ কোটি। এর ফলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়বে। কিন্তু উন্নত দেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে জন্মহার কমছে বলে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া জনশক্তিকে প্রতিস্থাপন করার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক তরুণ কর্মী বাহিনী থাকবে না। ফলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়লেও বেশিসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে, কমে যাবে বাড়ি-গাড়ির মতো মূল্যবান সামগ্রীর খাতে বড় অঙ্কের ব্যয়ের ক্ষমতা, ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। এই সমস্যার সমাধান প্রযুক্তির বিপ্লবের মধ্যে নিহিত আছে বলে শোয়াবের ধারণা।
শোয়াব দেখিয়েছেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও উদ্ভাবনের জন্য বিনিয়োগ সত্ত্বেও উৎপাদনশীলতা কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। ২০০৮ সালের মন্দার আগের প্রায় ছয় দশকের গড় উৎপাদনশীলতা ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ; আর পরের সাত বছরের উৎপাদনশীলতা ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। তাঁর প্রশ্ন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও স্বল্প ব্যয়ে অধিক ভোগের সম্ভাবনা সত্ত্বেও পরিসংখ্যানের এই অসংগতির কারণ কী? তাঁর ধারণা, চলতি শিল্পবিপ্লবের ফসল হিসেবে যে বাড়তি সেবা ও পণ্য ভোক্তাদের কাছে সুলভ হয়েছে, তার পরিমাপ গতানুগতিক ধারার পরিসংখ্যানের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে হাতের আঙুলের স্পর্শে ট্যাক্সি ডাকা কিংবা অনলাইনে সব ধরনের পণ্য ও সেবা পাওয়ার ব্যবস্থার মতো অসংখ্য উদ্ভাবনের ফলে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। কিন্তু সেই বাড়তি উৎপাদনশীলতার হিসাব আমাদের জাতীয় পরিসংখ্যান কিংবা অর্থনৈতিক সূচকগুলোর গতানুগতিক হিসাবে দেখতে পাওয়া যায় না।
যে নতুন শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে, তার অভিঘাতে বহু প্রতিষ্ঠিত শিল্প নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তির কাছে পরাজিত হতে চলেছে। এসব শিল্পকে শুধু উৎপাদন ব্যয় কমানোর গতানুগতিক ধারণা ছেড়ে নতুন উদ্ভাবিত কৌশলে সেবা ও পণ্য তৈরি করতে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বড় প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে শ্রমবাজারের ওপর। প্রযুক্তিজনিত বেকারত্ব নিয়ে ১৯৩১ সালে করা কেইনসের আশঙ্কা ভুল ছিল, সেটা উল্লেখ করে শোয়াব স্বীকার করেন যে চলমান বিপ্লবে প্রযুক্তির গতি ও বিস্তার আগের তিনটি বিপ্লবের চেয়ে অনেক বেশি অভিঘাত হানবে কর্মসংস্থানের ওপর। এটি মোকাবিলায় দুটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন শোয়াব। প্রথমত, প্রযুক্তি মানব শ্রমের জায়গা দখল করে নিলে কর্মী বাহিনী হয় বেকার হয়ে পড়বে কিংবা অস্তিত্বের লড়াইয়ে নিজের দক্ষতা নিয়োগ করবে বিকল্প পেশায়। দ্বিতীয়ত, নতুন সেবা ও পণ্য উদ্ভাবনের সঙ্গে তৈরি হবে নতুন ব্যবসা, শিল্প ও পেশা।
নতুন প্রযুক্তি শ্রমবাজারে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে, কিংবা সৃষ্টি করতে পারে চরম বেকারত্ব—এ দুই ধারণাকে শোয়াব চূড়ান্ত বলে
মনে করেন না। তাঁর ইতিহাসজাত ধারণা, ফলাফল হবে মাঝামাঝি। প্রযুক্তি কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে ঠিকই, তবে নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করে। শোয়াব উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন, অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস ২০০৮ সাল থেকে বাইরের কোম্পানিগুলোকে আইফোনের জন্য অ্যাপস বানানোর অনুমতি দিলে কীভাবে বিশ্বব্যাপী অ্যাপ প্রযুক্তি ও অর্থনীতির বিশাল উল্লম্ফন ঘটে। শোয়াব ২০১৫ সালের মধ্যে এ নতুন কর্মসংস্থানের ফলে ১০ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, তবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এখান থেকে প্রকৃতপক্ষে আয় হয় ৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। প্রযুক্তির প্রভাব কিছু ক্ষেত্রে কর্মহীনতা সৃষ্টি করলেও ভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, উৎপাদনশীলতা ও সম্পদ বৃদ্ধি করে। আবার এর প্রভাবে মানুষের চাহিদা বাড়বে, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান।
কিন্তু নতুন কর্মসংস্থানের সঙ্গে বেড়ে যাবে বৈষম্যের মাত্রা। কারণ, যারা বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তাদের বেকারত্বের সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন প্রযুক্তি অবলম্বন করে উন্নততর পেশায় যুক্ত শ্রমশক্তির সঙ্গে বৈষম্য। শুধু মানুষে মানুষে নয়, বৈষম্য দেখা দেবে দেশের সঙ্গে দেশের। কারণ, শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রযুক্তির উৎকর্ষে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকখানি এগিয়ে যাবে।
বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলো মোকাবিলা করার জন্য আমাদের জোরালো প্রস্তুতি নিতে হবে কালক্ষেপণ না করে। বিশাল অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ কর্মী বাহিনীর দক্ষতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে না পারলে এই শিল্পবিপ্লবই আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। প্রযুক্তির দ্রুতগামী ট্রেনে যারা চড়তে পারবে না, তাদের জন্য অপেক্ষা করবে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পাশাপাশি শুরু হয়েছে এই নতুন শিল্পবিপ্লবের সূচনা। প্রথমটিকে টেকসই করার জন্য এবং দ্বিতীয়টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও জোর দিতে হবে বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এটি নিশ্চিত করা না গেলে এই নতুন শিল্পবিপ্লবের সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারব না।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার
[email protected]