স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে কীভাবে তারা রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ‘চুরি’র ঘটনা ঠেকিয়ে দেশ ও জাতিকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। সাংবাদিকের মাধ্যমে ওই তথ্য দেশবাসী জেনে গেলে নাকি দুই বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে কোভিড টিকা ক্রয় প্রক্রিয়া নস্যাৎ হয়ে যেত।
তথ্য সংগ্রহের জন্য সচিবালয়ে যাওয়া প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে প্রায় ছয় ঘণ্টা স্বাস্থ্যসচিবের পাশের কক্ষে আটকে রেখে, তাঁর নামে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনে মামলা ঠুকে, তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে কৃতিত্ব জাহির করেছেন তাঁরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত বলতে পারেননি কবে নাগাদ চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি চূড়ান্ত হবে, কবে থেকে টিকা আসবে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য দেশে-বিদেশে নন্দিত সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনের ভাষায় হয়ে যান ‘জনৈক মহিলা’ এবং তাদের তদন্ত কমিটি গঠনসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তির ভাষায় ‘জনৈক রোজিনা’। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা একজন নারীর প্রতি এভাবেই ‘সম্মান’ দেখিয়েছেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা এই প্রথম। আইনজ্ঞদের মতে, ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার এই আইন করেছিল নিষিদ্ধ স্থানে থাকা রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য, মানচিত্র ইত্যাদি শত্রুরাষ্ট্রের কাছে কোনো সরকারি কর্মকর্তা যাতে পাচার করতে না পারেন, সেই উদ্দেশ্যে। কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হতে পারে না। তারপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মামলা করেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা যেভাবে নেটিভ বা দেশীয় কর্মকর্তাদের সন্দেহের চোখে দেখতেন, স্বাধীন বাংলাদেশে কতিপয় আমলা সাংবাদিকদের একই চোখে দেখেন।
বিচারাধীন মামলা নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী রোজিনা ইসলাম ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আমরাও আশা করি তিনি ন্যায়বিচার পাবেন। সেই সঙ্গে তাঁর ওপর যে অন্যায় করা হয়েছে, তারও বিচার হবে।
এ লেখায় মামলার বাদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতা কী কী মন্তব্য করেছেন, এই মন্ত্রণালয়ের কাজকে তাঁরা কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, সেসব পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কারণে চীন ও রাশিয়া থেকে করোনাভাইরাসের টিকা পেতে দেরি হচ্ছে। কারণ, দেশ দুটির কাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে টিকা পেতে যেসব প্রক্রিয়া শেষ করার কথা, তা সম্পন্নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেরি করেছে।
মোমেন বলেন, ‘আমরা চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছি। চীনের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। চীন আমাদের কাছে তিনটি ডকুমেন্ট পাঠিয়েছিল। দুটি ডকুমেন্ট আমরা তাদের ফেরত পাঠিয়েছি। দুটির মধ্যে একটি কালকে ফেরত পাঠিয়েছি, যেখানে একটি অংশ ছিল ইংরেজিতে এবং আরেকটি ছিল চীনা ভাষায়। আমরা (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) সই করে ফেরত পাঠানোর সময়ে চীনা ভাষার অংশে সই করেছি। এটা জানার পর চীনা ভাষার অভিজ্ঞ একজন অধ্যাপককে নিয়োগ করে সেটি (ডকুমেন্ট) সংশোধন করা হয়েছে। দিস আর লাউজি ওয়ার্ক এবং এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু যোগাযোগ করিয়ে দেয়। অন্য সব বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেখে। সেখানে একটু দেরি হচ্ছে।’
টিকা সংগ্রহের প্রস্তুতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতার উল্লেখ করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এ জন্য বেইজিংয়ে আমাদের রাষ্ট্রদূত অত্যন্ত হতাশ। কারণ, কাগজপত্র চূড়ান্ত না হলে প্রক্রিয়া শেষ হবে না। রাষ্ট্রদূত আমাকে ফোন করেছেন, টেক্সট করেছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তা স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, মুখ্য সচিবকে পাঠিয়ে দিয়েছি তাগাদা দেওয়ার জন্য।’
রাশিয়ার কাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে টিকা সংগ্রহে কালক্ষেপণেরও সমালোচনা করে মোমেন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে কিছু ডকুমেন্ট সই হয়েছে, কিছু হয়নি। শুরুতে তাদের কাছে থেকে টিকা নিতে একটি সংখ্যা বলা হয়েছিল এবং পরে আবার সংখ্যা বদল করা হলো। রাশানরা এটি পছন্দ করে না।
এবার দেখা যাক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কী বলেছেন। বুধবার অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, কোভিড রোগীদের ব্যবহারের জন্য ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটর কেনা হবে। উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়া সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এটি কেনা হচ্ছে। এতে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একমত। তবে স্বাস্থ্য খাত অত্যন্ত জরুরি বিষয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল এসব চাহিদার বিষয়ে যথাযথ সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেটি করেনি। করতে পারলে আরও সাশ্রয়ী হওয়া যেত। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে সাশ্রয়ী হতে বলে দেওয়া হয়েছে।’ অর্থমন্ত্রী কিন্তু এখানেই থামেননি। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বারবার যদি একই ভুল হয়, তাহলে অর্থনৈতিক ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে এগুলো বাদ যাবে।
আমরা দুশ্চিন্তায় আছি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কে দুই মন্ত্রীর এই সত্য ভাষণের জন্য তাঁদের নামে সেখানকার কোনো আমলা আরও দুটি মামলা ঠুকে দেন কি না। কী দুঃসাহস! কোভিড পরীক্ষা থেকে শুরু করে পিপিই সরবরাহে ‘অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনকারী’ মন্ত্রণালয়টিকে সরাসরি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।
মাহবুব উল আলম হানিফ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য। মঙ্গলবার তিনি তাঁর ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নয়, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে সচিবালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তাকে অত্যন্ত দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতা।
মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা বা ব্যক্তিবিশেষের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। আমরা চাই প্রতিটি মন্ত্রণালয় স্বচ্ছভাবে কাজ করুক, প্রধানমন্ত্রীর যে চিন্তাচেতনা, দেশের জন্য যে পরিকল্পনা, সেটি বাস্তবায়নে এগিয়ে যাক। দেশ এগিয়ে যাক, সরকারের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হোক।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মারুফা আক্তারও ফেসবুকে রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন এবং তাঁর মুক্তি দাবি করেছেন। মারুফা আক্তারের শেষ মন্তব্য ছিল, ‘দিন শেষে আমার পরিচয় আমি একজন সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী। সহযোদ্ধার হৃদয়ের রক্তক্ষরণে আমার হৃদয়েও রক্ত ঝরে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিক রোজিনার ওপর নির্যাতন ও নিগ্রহের যে ঘটনা ঘটেছে, বাংলাদেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ তার প্রতিবাদ করেছেন। সাংবাদিক সমাজ রাজপথে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এখানে সেসব আর পুনরুল্লেখ করলাম না। কেবল ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরলাম। এর কারণ যে মন্ত্রণালয়টি নিজেদের ভাবমূর্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য রক্ষায় উদ্গ্রীব, তাদের সম্পর্কে সরকারের ও ক্ষমতাসীন দলের ভেতরের মানুষজন কী ভাবেন, দেশবাসীর তা জানা দরকার। বিরোধী দলের উদাহরণ দিলে তাঁরা বলতেন, ওরা হয় বিএনপি, না হয় জামায়াত-শিবির। নাগরিক সমাজের নজির তুলে ধরলে বলতেন, ওরা সরকারের ভালো চায় না। এ কারণেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কে ঘরের লোকদের ভাবনা ও মূল্যায়ন তুলে ধরলাম।
গায়ের জোরে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে সচিবালয়ে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা যায়, মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানো যায়, কিন্তু তাতে মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও ব্যর্থতা ঢাকা যায় না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি