এই করোনাকালে যাঁরা বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রবাসী শ্রমিকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। আমাদের অর্থনীতির তিন প্রধান চালিকা শক্তির অন্যতম প্রবাসী শ্রমিক। অপর দুই চালিকা শক্তি কৃষক ও তৈরি পোশাকশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকেরা। কিন্তু এই প্রবাসী শ্রমিকেরা যে পদে পদে হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন, প্রতারিত হচ্ছেন—সে খবর নীতিনির্ধারকেরা কতটা রাখেন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। এটি গত বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। এই আশার বিপরীতে হতাশার খবর হলো, এ বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত মাত্র ১ লাখ ৮১ হাজার ২৭৩ জন বাংলাদেশির বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। গত বছর একই সময়ে কাজ পেয়েছিলেন ৪ লাখ ৬ হাজার ৯৬২ জন। চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৭ লাখ। আগামী দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছানো যাবে না। করোনার কারণে সারা বিশ্বেই অর্থনীতিতে মন্দা চলছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৪১ হাজার ৩৬ জন প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে ২৮ হাজার ৫৮৬ জন ট্রাভেল পাস নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে যাঁরা কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন, তাঁরা নিরুপায়। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির জরিপে বলা হয়, এই প্রবাসীদের ৮৭ শতাংশের আয়ের উৎস নেই। অথচ বিদেশফেরত ৯১ শতাংশই কোনো সহায়তা পাননি। বাকি ৯ শতাংশ সরকারি বা বেসরকারি খাত থেকে সামান্য সহযোগিতা পেয়েছেন। একজন প্রবাসী শ্রমিক বেকার হওয়া মানে একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চত হয়ে পড়া।
সম্প্রতি প্রতারিত ও নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরা ৮৩ জন শ্রমিককে জেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ভিয়েতনামফেরত ৮১ জন ও কাতারফেরত ২ জন। অভিযোগ, তাঁরা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। এর আগে কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন থেকে আসা ২১৯ জনকে জেলে নেওয়ার সময়ও একই অভিযোগ আনা হয়েছিল।
প্রবাসী শ্রমিকদের সমস্যা বহুমুখী। যে কাজ ও বেতনের কথা বলে তাঁদের বিদেশে পাঠানো হয়, সেই কাজ ও বেতন দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হন তাঁরা। সম্প্রতি প্রতারিত ও নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরা ৮৩ জন শ্রমিককে জেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ভিয়েতনামফেরত ৮১ জন ও কাতারফেরত ২ জন। অভিযোগ, তাঁরা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। এর আগে কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন থেকে আসা ২১৯ জনকে জেলে নেওয়ার সময়ও একই অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এসব শ্রমিক ভাগ্য বদলের আশায় চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন। প্রচলিত সব নিয়মকানুনই তাঁরা মেনে, সরকারের জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন, চাকরির আশ্বাস ছিল ভুয়া।
যেসব প্রবাসী শ্রমিক বিদেশে চাকরি পেয়েও টিকিট–ভিসা করে করোনার কারণে যেতে পারেননি, তাঁদের নতুন করে টিকিট–ভিসা করতে হচ্ছে। অনেক শ্রমিক চড়া দামে টিকিট কিনে, ট্রাভেল পারমিট নিয়েও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। গত ৯ অক্টোবর দুবাই থেকে ফিরে এসেছেন ১০৪ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। তাঁরা নির্দিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সি থেকে টিকিট কেনার পাশাপাশি বাড়তি অর্থের বিনিময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবেশের অনুমতিপত্রও নেন। কিন্তু দুবাই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁদের আটকে দেয়। এই প্রবাসী শ্রমিকেরা যে অনুমতিপত্র নিয়ে যান, তা–ও ছিল ভুয়া। তাঁরা ৭৪ ঘণ্টা দুবাই বিমানবন্দরে আটক ছিলেন। ভেতরে ঢুকতে না পেরে তাঁরা আবার দেশে ফিরে আসেন। অথচ তাঁরা ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ ১৯ হাজার টাকায় টিকিট কেটে গিয়েছিলেন।
প্রতারিত হয়ে ফিরে আসা প্রবাসীরা জানান, তাঁদের ৫৫ জন ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বাকি ৪৯ জন চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন। তাঁরা দুই দিন দুবাই অভিবাসন পুলিশের কারাগারে ছিলেন। সন্ধ্যায় ঢাকায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ফ্লাই দুবাইয়ের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রবাসীরা। ৩৯ জন প্রবাসী এতে স্বাক্ষর করেন। লিখিত অভিযোগে বলা হয়, দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকার কারণে কর্মস্থলে ফিরতে অনেকেই ব্যাংকঋণ, সুদের ওপরে ধার, সোনার গয়না বিক্রি করে ফ্লাই দুবাইয়ের টিকিট করেছিলেন। কিন্তু তাদের হয়রানির কারণে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরে এলাম। আর্থিক ক্ষতি আদায় করে দিতে অনুরোধ করেন তাঁরা। এর আগেও গত আগস্ট মাসে ১১০ জন প্রবাসী শ্রমিক আবুধাবি থেকে ফিরে এসেছিলেন।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশের কর্মীরা কাজ করতে যান। ১৯৩টি দেশের মধ্যে ৫৮টি দেশে কূটনৈতিক সংযোগ রাখার জন্য বাংলাদেশের ৭৭টি মিশন রয়েছে, এর মধ্যে ৫৯টি পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস। কয়েকটি দেশে রয়েছে একাধিক মিশন। আর ১৩৫টি দেশে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক মিশন নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশি শ্রমিকেরা কাজ করতে যান, এমন ১৬৮টি দেশের মধ্যে ১১০টি দেশে কোনো শ্রমকল্যাণ শাখা নেই। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ বছর ২০৪টি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে ১৬৩টি এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতারিত হওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ভুক্তভোগী প্রবাসীদের অভিযোগ, উচ্চ বেতন ও ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজের কথা বলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থায়ী কোনো কাজ পান না তাঁরা। এক বা দুই সপ্তাহ একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করানোর পর নিয়ে যাওয়া হয় অন্যটিতে। পাচারকারীদের ভাড়া করা বাড়িতে প্রবাসীদের আশ্রয় মিললেও থাকা-খাওয়ার খরচ বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে চলে নির্যাতন।
অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান, ১৯৯০ সালের আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশই সই করেনি। তাই তাঁদের কর্মীদের সুরক্ষা দিতে বাধ্য করার সুযোগ নেই। তাই সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানোর বাইরে কিছু করার নেই।
২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বলতে চাই, শুধু অর্থ উপার্জনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে অযথা কর্মীদের বিদেশে পাঠাবেন না। অনেক সময় দেখা যায়, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এজেন্টরা গ্রামবাংলার মানুষকে বিদেশে সোনার হরিণ পাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। ফলে সহজে প্রতারণার শিকার হয়ে তারা সবকিছু ছেড়ে বা বিক্রি করে বিদেশে চলে যায়।’ (ইউএনবি) প্রধানমন্ত্রীর ওই হুঁশিয়ারি যে কোনো কাজে আসেনি, তার প্রমাণ পদে পদে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতারিত হওয়ার উদ্বেগজনক খবর।
যেসব এজেন্সি ভুয়া নিয়োগপত্র ব্যবহার করে ভিয়েতনামে লোক পাঠিয়েছিল, তারা এখন দায় স্বীকার করতে চাইছে না। তারা বলছে, লাইসেন্সবিহীন এজেন্সিগুলো তাদের নাম ব্যবহার করে লোক পাঠিয়েছে। আইন অনুযায়ী বিদেশে শ্রমিকদের যেতে হলে যেকোনো রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যেতে হবে। তাদেরই দায়িত্ব নিয়োগকর্তার কাগজপত্র যাচাই করা। এজেন্সির দেওয়া কাগজপত্র সঠিক কি না, সেটি যাচাই করে মন্ত্রণালয়। ভিয়েতনামে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে মাসপ্রতি ৫০০ মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন তাঁদের স্থানীয় কোনো চাকরিই নেই। বিমানবন্দরে নামার পরই দালাল চক্র প্রত্যেকের পাসপোর্ট নিয়ে নেয়। ফলে তাঁরা রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক হয়ে পড়েন। তাঁদের হাতে কোনো অর্থও দেওয়া হয় না। এ অবস্থায় ভুক্তভোগীরা যদি বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে প্রতিকার চাইতে গিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন, সে জন্য তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না।
ভিয়েতনামফেরত শ্রমিকেরা প্রতারিত হয়েছেন। অথচ যারা তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, সরকার তাদের ধরতে না পেরে কারাগারে পাঠিয়েছেন ওই শ্রমিকদেরই। এটি শ্রমিকদের প্রতি কেবল অমানবিক আচরণ নয়, নিষ্ঠুরতাও বটে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি