গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নাসা জানিয়েছিল, বর্তমান পৃথিবী ২০ থেকে ২১ বছর আগের পৃথিবীর চেয়ে বেশি সবুজ! গত বছর থেকে দুই দশক আগের স্যাটেলাইট ইমেজের তুলনা করে নাসা এ তথ্য জানিয়েছিল। পৃথিবী থেকে সবুজ কমে যাচ্ছে—পরিবেশবাদীদের এ বয়ান নাসার তথ্যে বড়সড় ধাক্কা খেল। নাসার বক্তব্যটি অনেকে বিশ্বাসই করেননি। পশ্চিমের পরিবেশবাদী পত্রপত্রিকাও ব্লগ সাইটগুলো তথ্য যাচাইয়ে নেমেছিল। সেগুলোয় প্রমাণের চেষ্টা ছিল যে স্যাটেলাইট চিত্রে সবুজ রং বেশি ধরা পড়ার পেছনে চীনের একদল দুষ্টবুদ্ধি মানুষের কারসাজি রয়েছে। স্যাটেলাইটের আলোকচিত্রগুলো সেসব চালাকি ধরতে না পেরে ভ্রান্ত তথ্য দিচ্ছে।
২০১৪ সাল থেকে চীন সরকার কলকারখানাগুলোর চারপাশে সবুজ গাছগাছালির পর্যাপ্ত সমাবেশ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিল। সে জন্য কারখানার মালিকেরা একটি চালাকি করেছিল। ওপর থেকে তোলা স্যাটেলাইট ও ড্রোনের ক্যামেরায় ছবি যাতে কড়কড়া সবুজ দেখায়, সে জন্য বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে র্যাঞ্চ মালিকেরা ও ছোট ছোট শিল্পাঞ্চল কর্তৃপক্ষ মাইলের পর মাইল পাথরগুলোয় সবুজ রং মাখিয়ে সবুজ করে রেখেছিল। অনেক ক্ষেত্রে দালানকোঠা-স্থাপনাগুলোর রংও সবুজ করে দিয়েছিল। ঘটনা মিথ্যা নয়। তবে ২০১৮ সাল থেকে চীন সরকার এসব বাঁদরামি ও ছলচাতুরীকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিচ্ছে না; বরং চতুরদের দেদার জরিমানা করছে। পরিবেশ রক্ষায় চীন সিদ্ধান্তদৃঢ়। না হয়ে উপায় কী? অন্তত সাতটি বড় শহর ধোঁয়া-কুয়াশা বা স্মগে ঢাকা পড়েছে। দিনেরবেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। চীনে তাই কয়েক বছরজুড়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে বৃক্ষরোপণ চলছে। তাই নাসার স্যাটেলাইট ইমেজ ভুল প্রমাণিত হয়নি।
কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো পুনঃ সবুজায়ন, যেমনটি নাসা জানাচ্ছে? একদল পরিবেশপ্রেমী নীরবে-নিভৃতে গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন বলেই সম্ভব হয়েছে। অসাধারণ নিবেদিতপ্রাণ এই পরিবেশবাদীদের বৃহদংশই এমন দুটি দেশের মানুষ, যে দুটি দেশের সুনামের পাশাপাশি যথেষ্ট দুর্নামও আছে। নানা কারণে দেশ দুটির প্রতি অনেকের ঘৃণাও আছে! কিন্তু তাদের প্রশংসনীয় কাজের প্রশংসা না করাও বেঠিক! দেশ দুটি ভারত ও চীন। দেশ দুটির অনুপ্রেরণার উৎস কেনিয়া এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নোবেলজয়ী কেনীয় নারী ওয়াঙ্গারি মাথাই।
২০১৭ সালে ভারতের মধ্যপ্রদেশে নর্মদা নদীর দীর্ঘ অববাহিকায় প্রায় ১৫ লাখ নাগরিক বৃক্ষরোপণ উৎসবে নেমেছিল। এক দিনে মাত্র ১২ ঘণ্টায় তারা ৬৬ মিলিয়ন গাছ লাগিয়েছিল। এ ঘটনাকে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ওঠানোর জন্যও আবেদন করে রেখেছে ভারত। প্যারিস চুক্তির আলোকে ২০৩০ সালের মধ্যেই ভারত পাঁচ মিলিয়ন হেক্টর জমি বনায়নের আওতায় নিয়ে আনার মহাপরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছে। চীনও তার বনায়ন প্রকল্পে যুক্ত করেছে কয়েক বিলিয়ন গাছ। চীন গুয়াংজি প্রদেশে লিউঝুকে ‘বনের শহর’-এ (ফরেস্ট সিটি) পরিণত করতে চলেছে। ৩০ হাজার জনবসতির শহরটি ৪০ হাজার গাছে শোভিত থাকবে। লিউঝুকে ‘বনের শহর’ বানানোর কাজ শেষের দিকে। আস্তে আস্তে আরও অনেক শহরকে বনের শহরে রূপান্তরিত করা হবে। বলা যায়, ভারত ও চীনে প্রতিদিনই কয়েক লাখ গাছ নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে।
অপ্রিয় শোনালেও সত্য যে ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের পরিবেশ-ভাবনার ধারেকাছেও যেতে পারেনি গ্রেটা থুনবার্গ। ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের একটি বৈশ্বিক দূরদৃষ্টিময় প্রকল্প ছিল। তাঁর ‘বহুদেশিক পরিবেশগত সুবিচার’ প্রকল্পটির ভাষ্য কী? কয়েকটি বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেছেন যে শুধুই গাছ লাগানো বিশ্বপরিবেশের জন্য মোটেই শেষ কথা নয়, বরং শুরুর কথামাত্র।
২০০৭ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থার ‘বিলিয়ন ট্রি’ ক্যাম্পেইনের ফলে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বে সাড়ে ১৪ বিলিয়ন গাছ লাগানো হয়েছে। ২০১৭ সালে এসে আন্দোলনটি ‘ট্রিলিয়ন ট্রি’ ক্যাম্পেইন নাম নেয়! এসব অগ্রগতির পেছনে একক অবদান ‘দ্য গ্রিন বেল্ট’ আন্দোলনটির পথিকৃৎ প্রফেসর ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের। তাঁর দেশ কেনিয়া। দেশটি এমনিতেই সবুজ। তবু ৩০ মিলিয়ন গাছ লাগিয়েছিলেন ‘দ্য গ্রিন বেল্ট’ আন্দোলনের কর্মীরা। পরিবেশ আন্দোলনের মাধ্যমে ১০ লাখ নারীর ক্ষমতায়নও ঘটেছিল তাঁর হাতে। কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ওয়াঙ্গারি মাথাই ২০০৪ সালে নোবেলও পেলেন। ২০১১ সালে তাঁর প্রয়াণ ঘটল।
ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের মৃত্যুদিবস ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর। খুব নীরবে দিনটি চলে গেল। ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন’ সপ্তায় বিশ্ব সংবাদমাধ্যম গ্রেটা থুনবার্গকে নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকল যে মাথাইয়ের নামও শোনা গেল না কোথাও! পরিবেশসচেতনতা আন্দোলনে নতুন ঢেউ আনতে পারায় গ্রেটা ধন্যবাদার্হ নিঃসন্দেহে! গ্রেটা কিশোরী হওয়ায় তার প্রতি দুনিয়াও সহানুভূতিশীল। এ বছর বিবিসির জরিপেও গ্রেটা বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর মধ্যে অন্যতম একজনের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু মাথাইয়ের ‘ট্রান্সন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিস’ বা ‘বহুদেশিক পরিবেশ সুবিচার’ বিষয়ে সবল-বলিষ্ঠ চিৎকারের মতো পরিণত স্বর গ্রেটার থাকার কথা নয়! গ্রেটার বয়স বাড়তে থাকলে হয়তো জনসহানুভূতিও পড়ে যাবে। তা ছাড়া ভয় হয় গ্রেটাকে না আবার রোমান্টিক পুঁজিবাদ পরিবেশ-ভাবালুতার ‘পোস্টার গার্ল’ বানিয়ে ছাড়ে!
এ আশঙ্কার পেছনে কারণ রয়েছে। ২০২০ সালকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উদ্যোগে ‘বিশ্ব বৃক্ষস্বাস্থ্য বর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০২০ সাল শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু এ বিষয়ে কোথাও তেমন সাড়াশব্দ নেই। গ্রেটাকেও কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। নাসার প্রতিবেদনটি ছিল গত বছর আমাজনে এবং যুক্তরাষ্ট্রে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে ভয়াবহ দাবদাহের কিছুদিন আগের। নাসার এখনকার ইমেজ দেখা নিশ্চয়ই গত বছরের মতো আশাজাগানিয়া কিছু হবে না। খোদ বাংলাদেশেই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে প্রায় সাড়ে চার হাজার একর ভূমি বৃক্ষশূন্য হয়েছে। স্যাটেলাইট ইমেজে জায়গাটিতে সবুজহীন বিরানভূমি মনে হয়। গ্রেটার নীরবতার দিকে যাত্রা থেকে এমনটিই মনে হয়েছে যে সে সম্ভবত বর্ষটির গুরুত্ব সম্পর্কেই যথার্থ ওয়াকিবহাল নয়। এ কথা সত্য যে করোনার মতো ভয়াবহ অতিমারিটি অন্য সব প্রয়োজনীয় বিষয় থেকে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু পরিবেশবিষয়ক সক্রিয় আন্দোলনের পুরোধাদের বেলায় এ অজুহাত গ্রহণীয় নয়।
অপ্রিয় শোনালেও সত্য যে ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের পরিবেশ-ভাবনার ধারেকাছেও যেতে পারেনি গ্রেটা থুনবার্গ। ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের একটি বৈশ্বিক দূরদৃষ্টিময় প্রকল্প ছিল। তাঁর ‘বহুদেশিক পরিবেশগত সুবিচার’ প্রকল্পটির ভাষ্য কী? কয়েকটি বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেছেন যে শুধুই গাছ লাগানো বিশ্বপরিবেশের জন্য মোটেই শেষ কথা নয়, বরং শুরুর কথামাত্র। ‘পরিবেশগত ন্যায়বিচার’ না থাকলে শুধুই বৃক্ষরোপণ টেকসই ব্যবস্থা হয়ে উঠবে না। পরিবেশ-ন্যায়বিচারের জন্য তিনি পরিবেশের রাজনীতির সততা ও ন্যায্যতার কথা বলতেন। তাঁর ‘পরিবেশগত ন্যায়বিচার’ ভাষ্যটির উদাহরণ এ রকম যে বাংলাদেশ জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে ভারতকে বলতে পারছে, গাছ লাগানোয় যেমন দায়িত্ববান হয়েছ, তিস্তার পানির ন্যায্য বণ্টনেও সততা দেখানো তোমাদের সমান দায়িত্ব। বাংলাদেশ যেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পারছে ন্যায্য পানিবণ্টন ‘ট্রান্সন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিস’ বিষয়ে তোমার অনিবার্য দায়, দয়াদাক্ষিণ্য নয়। বাংলাদেশ যেন অনায়াসে বলতে পারছে ফারাক্কা বাঁধের একতরফা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দুর্যোগকবলিত করে রাখা ‘বহুদেশিক পরিবেশ সুবিচার’-এর সুস্পষ্ট ব্যত্যয়। আন্তর্জাতিক আইনেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ওয়াঙ্গারি মাথাই আরও বলেছিলেন, বৃক্ষরোপণ সহজ, তাতে কৃতিত্বের বিশেষ কিছু নেই। বৃক্ষ-বনজকে টিকিয়ে রাখা, রোগমুক্ত রাখা ও নিধনের হাত থেকে রক্ষা করাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ২০২০ সাল ‘আন্তর্জাতিক বৃক্ষস্বাস্থ্য বর্ষ’ হিসেবে পালিত হওয়া মাথাইয়ের পরিবেশ-দর্শনেরই সুফলমাত্র। তাই গ্রেটার পোস্টার গার্ল হয়ে পড়ার ফাঁকতালে ওয়াঙ্গারি মাথাই যেন কোনোভাবেই বিস্মৃত না হন। মাথাইয়ের পরিবেশ-ভাবনার গূঢ়তম অনুধাবনই শুধু নয়, চর্চা দরকার। কারণ, তিনি শুধুই ‘সবুজ পরিবেশ’-ভাবনায় আটকে থাকেননি। ‘বহুদেশিক পরিবেশ-সুবিচার’ পরিবেশবিষয়ক একটি পরিণত রাজনৈতিক ভাবনা ও বৈশ্বিক দর্শন।
জীবিত গ্রেটা চলতি আন্দোলনে থাকুক। আমাদের প্রত্যাশা, সে ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের মতো মৌলিক পরিবেশ-দর্শনে ঋদ্ধ পরিবেশকর্মী হয়ে উঠুন।
ড. হেলাল মহিউদ্দীন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের অধ্যাপক