গ্রানাইট খনি: রাষ্ট্রীয় ক্ষতির দায় কার?

দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ গ্রানাইট পাথরের খনি
দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ গ্রানাইট পাথরের খনি

দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ গ্রানাইট পাথরের খনি। ২০০৭ সাল থেকে এ পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। অতি উন্নত মানের এবং দেশে চলমান ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নকাজে, যেমন বৃহৎ সেতু, সড়ক ও মহাসড়ক, নদীশাসন, নদীভাঙন রোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে এই কঠিন শিলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মধ্যপাড়া খনিটির দায়িত্বে নিয়োজিত পেট্রোবাংলার অঙ্গসংগঠন মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির সঙ্গে জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) নামধারী এক কোম্পানি একটি চুক্তির মাধ্যমে বর্তমানে খনি পরিচালনা ও পাথর উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

কিন্তু খনি পরিচালনা ও উত্তোলন কর্মকাণ্ডে এই কোম্পানির অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে গত পাঁচ বছরে কঠিন শিলা উত্তোলনে ধস নামে। ছয় বছর মেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলন করে দেওয়ার কথা। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ সময়ের শেষ বছরে এসেও আজ অবধি কোম্পানিটি মাত্র ৩০ লাখ টন পাথর উত্তোলন করেছে। উত্তোলনের কাজের নিম্ন ধারা চুক্তিবদ্ধ সময়ের দ্বিতীয় বছরেই ফুটে ওঠে, চুক্তি অনুযায়ী ১৪ লাখ টন পাথর উত্তোলনের কথা থাকলেও উত্তোলিত হয় ৫ লাখ টন। তৃতীয় বছর ১৬ লাখ টন পাথর উত্তোলনের স্থলে উত্তোলন করা হয় মাত্র ১ লাখ টন এবং চতুর্থ বছরে ১৭ লাখ টনের স্থলে উত্তোলন করা হয় মাত্র ৪ লাখ টন। অধিকন্তু চুক্তিবদ্ধ সময়ের মধ্যে প্রায় এক বছরের বেশি সময় পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকে। বর্তমানে এপ্রিল থেকে এক মাসের অধিক সময়ব্যাপী কারিগরি অব্যবস্থাপনার কারণে পুনরায় পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। মধ্যপাড়া খনি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, চুক্তিবদ্ধ সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ পাথর উত্তোলন করে না দেওয়ার ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠেছে, এ ক্ষতির দায় কে নেবে।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট পাথরের মজুতটি ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ আবিষ্কার করে। এখানে প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় অতি অল্প গভীরতায় গ্রানাইট পাথরের মজুত ১৭ কোটি ৪০ লাখ টন বলে প্রমাণিত হয়, যার প্রায় ৪২ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য। বছরে ১৬ লাখ টন করে উত্তোলনের মাত্রা ধরে নির্মিত এই খনি ৭০ বছর ধরে উত্তোলনে থাকতে পারে বলে হিসাব করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তির অধীনে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নামনাম ২০০৭ সালে খনিটি নির্মাণ শেষ করে এবং উৎপাদনে নিয়ে আসে। ২০১৪ সাল থেকে খনিটি পরিচালনা ও পাথর উত্তোলনের দায়িত্ব একটি চুক্তির মাধ্যমে জিটিসিকে দেওয়া হয়। কোম্পানিটি জার্মানিয়া করপোরেশন নামে বাংলাদেশি এক পরামর্শক সংস্থা এবং ট্রেস্ট শাখতস নামে বেলারুশের একটি সংস্থার সমন্বয়ে গঠন করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশি সংস্থাটির অন্য কোথাও কোনো কার্যক্রম আছে বলে জানা যায়নি এবং কেবল মধ্যপাড়া খনির কাজ পেতেই এটি গঠিত হয়। এটির কর্ণধার একজন বাংলাদেশি, যিনি রাশিয়ায় উচ্চতর শিক্ষা শেষ করে জার্মানিতে বসবাসের সূত্রে জার্মানির নাগরিকত্ব লাভ করেন বলে জানা যায়।

কোম্পানিটির সঙ্গে সম্পাদিত ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার চুক্তি অনুযায়ী খনিটিতে ছয় বছরে ১২টি স্টোপ নির্মাণ করে, তা থেকে মোট ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, খনি উন্নয়নে কারিগরি ডিজাইন ড্রয়িং প্রণয়ন এবং নানাবিধ ভূগর্ভস্থ নির্মাণ কর্মকাণ্ড সম্পাদনের মাধ্যমে খনিটিকে আধুনিক ধাঁচে পরিবর্ধন করা এবং তার পরিকল্পনা আগে থেকে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইন কোম্পানিকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু জিটিসি কোম্পানি প্রথম থেকেই কর্তব্যে অবহেলা ও চুক্তির ধারা তোয়াক্কা না করে সময়ক্ষেপণ করে।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৫-১৬) বিষয়টি সুস্পষ্ট করে লিপিবদ্ধ করা হয়। তাতে বলা হয়, চুক্তির ৪২.১ এবং ৪২.২ ধারা অনুযায়ী, জিটিসি কর্তৃক ছয় বছর সময়ের ‘টাইম বাউন্ড অ্যাকটিভিটি শিডিউলড’ পেশ করার কথা থাকলেও জিটিসি তা পেশ করেনি। কেবল তা–ই নয়, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, চুক্তিবদ্ধ ১ হাজার ৪০০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন খাতের পাওনা ইতিমধ্যেই জিটিসি কোম্পানি কখনো চাটুকারের আশ্রয় নিয়ে, কখনোবা বিশেষ মহলের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে হাতিয়ে নেয়। অথচ তার বিপরীতে যে ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলন করে দেওয়ার কথা, তার মধ্যে কেবল ৩০ লাখ টন পাথর উত্তোলন করে। চুক্তিবদ্ধ সময়ের বাকি মাত্র আট মাস সময়ে চুক্তিবদ্ধ পরিমাণ পাথর তোলা সম্ভব নয়, তা নিশ্চিত। আর এর ফলে ৬০০ কোটি টাকার যে ক্ষতি হবে, তার ভার এসে পড়বে বাংলাদেশের ওপর।

কঠিন শিলা ব্যবহারকারী সংস্থাসমূহে বাংলাদেশের নিজস্ব পাথর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবহৃত হবে, এটিই সবার কাম্য। এতে একদিকে যেমন সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পাওয়ার সুবিধা রয়েছে, তেমনি নিজ দেশের খনিশিল্পের প্রসার লাভ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের নিজ পায়ে দাঁড়ানোর প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এ সেতু নির্মাণে নদীশাসনের কাজে এবং অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণে যে বিপুল পরিমাণ পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে, তা মধ্যপাড়া খনি থেকে নেওয়া হচ্ছে না, বরং ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে আনা হচ্ছে।

গুণগত মানের দিক থেকে মধ্যপাড়া খনির পাথর বিদেশ থেকে আমদানি করা পাথরের তুলনায় উন্নত মানের অথবা সমমানের। দামের দিক থেকেও মধ্যপাড়া গ্রানাইট পাথর (টনপ্রতি ৩৫ ডলার) ভারত থেকে আমদানি করা পাথরের ((টনপ্রতি ৪০ ডলার) তুলনায় সাশ্রয়ী। মধ্যপাড়া পাথরের টুকরোর সাইজ চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা সম্ভব এবং তা না করে বিদেশি পাথর আমদানি করা মোটেই যুক্তিসংগত নয়। এর পেছনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের চতুর চাল জড়িত, তা বলাই বাহুল্য। এমনকি অতীতে খনি কর্তৃপক্ষের কোনো কোনো সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিও এসব সিন্ডিকেটের অদৃশ্য সহযোগী হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এর ফলে লাভবান হন কর্মকর্তা, ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র।

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মধ্যপাড়া পাথর না কেনার অন্য একটি কারণ হতাশাজনক এবং এর জন্য সরকারি নীতির অসম প্রয়োগই দায়ী। সম্প্রতি সরকার পাথর পরিবহনকারী যানবাহনে পাথরের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী দেশের যেকোনো স্থানে ১০ চাকার একটি ট্রাক সর্বোচ্চ ২৪ টন পাথর বহন করতে পারবে, যেটি আগে ৪০ টন বা তার বেশি পাথর বহন করত। নিয়মটি আদর্শিকভাবে ন্যায্য হতে পারে, কিন্তু তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। যেমন মধ্যপাড়া খনি কর্তৃপক্ষের জন্য এ নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং তাই খনি কোম্পানি তার কোনো ব্যত্যয় ঘটায় না। কিন্তু সীমান্তের ওপার থেকে বা বিদেশের যেকোনো স্থান থেকে আমদানি করা পাথর যখন বাংলাদেশে সড়কে ট্রাক দ্বারা পরিবহন করা হয়, তখন এ নিয়ম প্রয়োগ হয় না। সুতরাং একজন ব্যবসায়ী পাথর ক্রেতা মধ্যপাড়া থেকে পাথর কিনে দুটি ট্রাক ভাড়া করে
তা ঢাকা পর্যন্ত আনতে যে খরচ করবেন, তিনি আমদানি করা পাথর কিনে একটি ট্রাকে করেই ওই পরিমাণ পাথর অপেক্ষাকৃত কম পরিবহন খরচে ঢাকায় নিয়ে আসতে পারবেন। তাই তিনি মধ্যপাড়ার পাথর না কিনে আমদানি করা পাথর কিনতে অধিকতর আগ্রহী হন।

দেশীয় খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও ব্যবহার জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার ÿক্ষমতা রাখে। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস অর্থনীতির চাকাকে এগিয়ে নিতে বহু বছর ধরে অবদান রেখে এসেছে, যদিও কখনো কখনো এর ব্যবস্থাপনা দুর্নীতি ও দুর্বলতার দূষণে দুষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে বড় আকারে কয়লা উধাও হওয়ার অভিযোগ ও কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের খনিশিল্প উন্নয়নকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে। বর্তমানে মধ্যপাড়া গ্রানাইট পাথরের এই অব্যবস্থাপনা দেশের খনি উন্নয়ন ও সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে আরও একটি ধাক্কা। প্রশ্ন হলো, কেন বাংলাদেশকে বারবার নিজের সম্পদ আহরণে হোঁচট খেতে হয়। কেন বিদেশি অসৎ বণিকের দল বাংলাদেশে সম্পদ লুণ্ঠনে দেশীয় দোসরদের সঙ্গে নিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিলের পথ খুঁজে পায়।

এসব কর্মকাণ্ড নজরদারি বা তদারক করার দায়িত্বে নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সেটি পেট্রোবাংলা হোক বা মন্ত্রণালয় হোক, তাদের দায়িত্বে অবহেলা কি অস্বীকার করতে পারে?


ড. বদরূল ইমাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ