‘মা, টিভি বন্ধ কোরো না’ বলে সাত বছরের যে শিশুটি বাবার সঙ্গে বাড়ির কাছের মসজিদে গিয়েছিল, সেই জুবায়ের তার মায়ের কাছে আর ফেরেনি। নারায়ণগঞ্জের মসজিদের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে অন্য আরও অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে তারও মৃত্যু হয়েছে। মসজিদের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ নির্ধারণে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হয়তো আরও হবে। কিন্তু একটি বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট যে গ্যাসলাইনে ছিদ্র থাকার কারণে বেশ কয়েক দিন ধরেই সেখানে বাতাস দাহ্য হয়ে পড়েছিল। গ্যাস কোম্পানির কয়েকজন মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলী ও কর্মী বরখাস্ত হয়েছেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় ত্রুটির জন্য দায়ী বড় কর্তাদের কিছু হয়নি। যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠানটি চলে, তাঁরাও কেউ কোনো দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করেছেন বলে শোনা যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা, মসজিদ কমিটি এবং স্থানীয় লোকজন সবাই এ অভিন্ন কারণটির কথা বলেছেন।
গ্যাস সরবরাহের এ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের দায়িত্ব যে কোম্পানির, সেই তিতাসের আঞ্চলিক কর্মকর্তা অবশ্য তা স্বীকার করেননি। বরং বলেছেন, তাঁদের কাছে কেউ এমন অভিযোগ করেনি। আর কোম্পানির প্রধান ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, বিষয়টি তদন্ত করা হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ আইন যে দেশটির নজির অনুসরণে প্রণীত, সেই যুক্তরাজ্যে এ ধরনের ঘটনায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, কিন্তু হত্যা—এ অভিযোগে মামলা হতো। বাংলাদেশে অবশ্য এ ধরনের কোনো আইন নেই। এ ধরনের আইন অন্য অনেক দেশেই আছে। দায়িত্বে অবহেলা কিংবা আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সাবধানতা অনুসরণ না করার ফলে কারও মৃত্যু ঘটলে সেই মৃত্যুর জন্য যে বা যারা দায়ী, তাদের বিচারই হলো এ আইনের উদ্দেশ্য। করপোরেট ম্যানস্লটারের ক্ষেত্রে ব্যক্তির জায়গায় কোম্পানিকেও একটি সত্তা হিসেবে গণ্য করা হয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহের মতো পরিষেবা দেওয়ার ব্যবসায় নিয়োজিত কোম্পানিগুলোর জন্যও গ্রাহকদের নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের জন্যও আলাদা জুতসই কোনো আইন নেই।
কর্তৃপক্ষের অবহেলার জন্য চার বছরের শিশু জিহাদের মৃত্যুর কথা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। ঢাকার শাহজাহানপুরে রেলওয়ের মাঠে একটি পরিত্যক্ত পানির পাইপে পড়ে গিয়ে জিহাদের মৃত্যু হয়েছিল। পানির পাইপের মুখটি খোলা থাকার কারণে রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জিহাদের বাবা মামলা করলে সেই মামলায় বিশেষ জজের আদালত রেলের তিনজন এবং একজন ঠিকাদারের ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করেন। কিন্তু হাইকোর্টে সেই রায় নাকচ হয়ে যায় এবং সবাই খালাস পেয়ে যান।
হাইকোর্টে রায় খারিজ হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয় রেলওয়ে ম্যানুয়ালে ওই পরিত্যক্ত পাইপের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দণ্ডিত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের নয়। তঁাদের যে আইনে সাজা দেওয়া হয়েছিল, সেটিও ঠিক ছিল না বলে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়। হাইকোর্টের রায়ে ঘটনাটিকে অবহেলাজনিত হত্যা নয়, বরং দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির সুনির্দিষ্ট আইন কতটা প্রয়োজন ও জরুরি, এই মামলা তার একটি দুর্ভাগ্যজনক প্রতীক।
অবশ্য এর আগের আরও একাধিক দৃষ্টান্ত আছে, যেগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির কাউকেই কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের ঘটনাটি হয়তো আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। ঢাকার বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটিপূর্ণ কাজের ফলে সেখানকার একটি ছয়তলা ভবন সিলভারস্টোন স্যাফায়ার এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে তা বসবাসের অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিল। ভবনটির মালিকের ছেলে দগ্ধ হন এবং আহত হন ছয়জন। ভবনের মালিক তিতাস কর্তৃপক্ষকে তিনবার গ্যাসলাইন থেকে গ্যাস বেরোনোর কথা জানালেও কোনো কাজ হয়নি। কয়েক দিন পর সরকার তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় বলে সংবাদপত্রগুলোতে খবর বের হয়। তবে অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। বনানীর সঙ্গে তো আর সব এলাকার তুলনা চলে না।
ওই বছরেরই ১১ এপ্রিল প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকার মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় রাত তিনটার সময় গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণে আগুন লাগার খবর জানানোর পর তিতাস গ্যাসের কর্তব্যরত কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘মানুষ তো আর আগুনে পুড়ে মরেনি। এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই।’
এর আগে, সে বছরেই ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে একই পরিবারের চার সদস্য মারা যান। গত কয়েক বছরের সংবাদপত্রগুলো খুঁজলে এ রকম আরও অনেক ঘটনার খবর মিলবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়িত্বহীনতার পরিণতিতে অবহেলাজনিত হত্যা ও জখমের ঘটনা ঘটলেও খবরে তা আসে দুর্ঘটনা হিসেবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতেও কখনো কখনো আইনগত প্রতিকার চাওয়ার কেউ থাকে না। যদি কেউ থাকেও, তাহলে দেখা যায় মামলা করার পর তদবিরের অভাবে বছরের পর বছর সেগুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় থেকে যায়। প্রচলিত ফৌজদারি আইনে এ ধরনের মামলার বিচারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি শিশু জিহাদের মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে উঠে এসেছে। ভুক্তভোগীর পরিবারগুলোর অসহায়ত্বের অবসানে তাই এমন আইনগত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে তাঁরা সহজেই বিচার এবং ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।
মসজিদে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কেন এবং কতটা প্রয়োজন অথবা তা গ্যাস পাইপলাইনের ওপর বৈধভাবে না বেআইনিভাবে নির্মিত হয়েছে—এ ধরনের অনেক প্রশ্নই এখন উঠেছে। তবে অপ্রাসঙ্গিক কিংবা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বিতর্কের জন্ম দিয়ে অনেকেই অত্যন্ত গুরুতর দায়িত্বহীনতার বিষয়টিকে আড়াল করে ফেলছেন বা গুরুত্বহীন করে তুলছেন। সব বেআইনি কাজের মূলে আছে প্রশাসনের জবাবদিহির অভাব। মসজিদটি যদি বেআইনিভাবে নির্মিত হয়েও থাকে, তাহলে তার দায়ও প্রশাসনের ওপরই বর্তায়। যেকোনো স্থাপনা নির্মাণে সরকারের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ও সহায়তা প্রয়োজন হয়। অনিয়ম বা আইন লঙ্ঘন হয়ে থাকলে সেটি প্রতিকারের ব্যর্থতা কার?
বছর বছর গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় সেবার মান উন্নয়নের প্রশ্নটিকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রমাণ মেলে না। অথচ তার পরিণতি হচ্ছে বেশি দামে বেশি মৃত্যু কেনা। নারায়ণগঞ্জে এই মসজিদের ক্ষেত্রে সরকারি এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতার পরিণতি ৩১ জন মানুষের প্রাণহানি। নিশ্চিত অবহেলার কারণেই এসব মৃত্যু ঘটেছে। এ অবহেলা অপরাধ তো বটেই, এর অন্য আরেকটি দিক হচ্ছে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর ক্ষতির প্রশ্ন। এসব পরিবারের কেউ হারিয়েছেন একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে, কেউ হারিয়েছেন অপার সম্ভাবনাময় তরুণ সন্তানকে। কিন্তু তাঁদের ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়াও অস্পষ্ট ও জটিল।
বাংলাদেশ গ্যাস আইন ২০১০ এবং তিতাসের গ্যাস সংযোগ নীতিমালায় গ্রাহকদের জরিমানাসহ নানা ধরনের সাজার কথা আছে। কিন্তু দুটির কোনোটিতেই গ্রাহকের ক্ষতিপূরণে কোম্পানির দায়দায়িত্বের বিষয়ে কিছু নেই। অর্থাৎ অপরাধ হিসেবে ফৌজদারি বিচার কিংবা ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি বিচার কোনোটিরই কোনো পথ খোলা নেই।
এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। অবহেলাজনিত মৃত্যু বা হত্যার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দায় নির্ধারণে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় ধরনের আইন প্রণয়ন করা এবং তা কার্যকর করার প্রসঙ্গটিকেই এখন অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক