গ্যাসের বিস্ফোরণে বহুদিন ধরেই মৃত্যুর মিছিল চলছে, আমরা কেবলই ‘দোষী’ খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু এর প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক একটি পদ্ধতি উন্নত বিশ্বে বহু বছর ধরে চলে আসছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলছি না, ভাবছি না, দেখে অবাক হচ্ছি। বিষয়টি আমার পদার্থবিজ্ঞান শাখার কিছুটা বাইরে বলে এত দিন কিছু লেখা হয়নি, ভেবেছি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে তা আসা উচিত। ৯ জুলাই প্রথম আলোয় বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা রাজিয়ার লেখাটি এ জন্য খুব ভালো লাগল। দেরিতে হলেও এ বিষয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকের এটিই বোধ হয় প্রথম লেখা। সেখানে সুন্দরভাবে অনেকগুলো দিক তিনি তুলে ধরেছেন। এ জন্য তাঁকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
কিন্তু গ্যাস বিস্ফোরণের প্রতিরোধে যে বিষয়টিকে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, সেটি তাঁর লেখাতে আসেনি। তিনি বলেছেন যে গ্যাস লিক হলে গন্ধ পাওয়া যাবে, যেটিকে তার পূর্বলক্ষণ হিসেবে ধরে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ বিষয়ে আমার বলার বিষয় হচ্ছে, সব প্রাকৃতিক গ্যাসে গন্ধ থাকে না। আর পাঠকদেরও অনুরোধ করব ইন্টারনেটে একটু অনুসন্ধান করতে, ইন্টারনেটের এ যুগে সেটি এখন খুবই সহজ। দেখবেন, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তার মূল উপাদান মিথেন গ্যাসের কোনো স্বাদ নেই, গন্ধ নেই। তাই ঘরে বা বাইরে কোথাও গ্যাস লিক হলে গন্ধ পাওয়ার কথা নয়। রান্নাঘরে চুলা না জ্বালিয়ে সামান্য একটু সময় (বেশি সময় ধরে অবশ্যই নয়!) গ্যাস চালু করে দেখুন তো, কোনো গন্ধ পান কি না। পাবেন না, কারণ এ গ্যাসে কোনো গন্ধ থাকার কথা নয়।
পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের যথাযথ স্থানে এবং সিএনজি, এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডারে ভরার আগেই গন্ধ দেওয়ার রাসায়নিক মেশানোর ব্যবস্থা করুন এবং তা এখনই। এক মুহূর্ত দেরি করার সময় নেই।
জার্মানিতে প্রায় ১৪০ বছর আগে প্রথম সরবরাহ করা গ্যাসের সঙ্গে ‘মারক্যাপটান’ নামে আলাদা একটি গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়। ১৯৩৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের একটি স্কুলে গ্যাস বিস্ফোরণে প্রায় ৩০০ মানুষের মৃত্যুর পর গ্যাসে গন্ধ মেশানোর জন্য আইনি কড়াকড়ি করার দিকে সবার নজর আসে। সব উন্নত দেশেই সরবরাহ করা গ্যাসে গন্ধ মেশানোর জন্য আইনি বাধ্যবাধকতাও আছে। পাঠকদের অনেকেই উন্নত বিশ্বে গেছেন ও থেকেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই চুলা থেকে গ্যাস বেরোলে গন্ধও পেয়েছেন। যত দূর মনে পড়ে বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহ যখন শুরু হয়, তখন এ ধরনের গন্ধ পাওয়া যেত। কিন্তু কবে কখন থেকে তা বন্ধ করা হয়েছে, তা মনে পড়ছে না। আর কয়েক যুগ ধরে গ্যাসে গন্ধ ব্যবহার না করায় বিষয়টি আমাদের সামগ্রিক চিন্তা থেকে এমনভাবে হারিয়ে গেছে যে দেশের বিশেষজ্ঞদের ভাবনার মধ্যেও সেটি এখন নেই।
সংবাদমাধ্যমে আসা আরেকটি তথ্য নিয়ে একটু বলা দরকার। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে ও মগবাজারে বিস্ফোরণের আগে-পরে কেউ কেউ গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সেটি তাহলে কীভাবে হলো? এখানে আমার বিশ্লেষণ হচ্ছে, শহরের তরল বর্জ্য পরিবহনের জন্য যে নর্দমা বা সুয়ারেজ লাইন আছে, তাতে বিভিন্ন জৈবিক পদার্থের পচনের ফলে হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়াসহ আরও কিছু কিছু গ্যাস তৈরি হয়, যাকে বলা হয় ‘সুয়্যার গ্যাস’। এ দুটো গ্যাসেই কিন্তু গন্ধ আছে। অনেক সময়ই গ্যাসের পাইপ সুয়ারেজ লাইনের ভেতরে বা কাছেই থাকে। লিক করা প্রাকৃতিক গ্যাস তখন এ সুয়্যার গ্যাসকে নিয়ে বের হয় বিধায় গন্ধ পাওয়া যায়।
একটি বিষয় খেয়াল করে দেখবেন, যেসব বাড়িতে ওপরের তলায় গ্যাস বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখানে কিন্তু কোনো গন্ধ পাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে আসেনি, কারণ সেখানে সুয়্যার গ্যাস মেশার কারণটি ঘটেনি। তাই বিষয়টি সবার জন্য পরিষ্কার হওয়া দরকার যে প্রাকৃতিক গ্যাসে গন্ধ নেই। আমাদের দেশে এখন সিএনজি, এলপিজি গ্যাসের বহুল প্রচলন। এসবেরও কিন্তু গন্ধ নেই এবং উন্নত বিশ্বে এলপিজির জন্য একটি ভিন্ন ধরনের মারক্যাপটান ব্যবহার করা হয়, গন্ধ দেওয়ার জন্য। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা আমার থেকে ভালো জানবেন।
ইতিমধ্যে বহু জীবন চলে গেছে, সম্পদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমি সরকারের নীতিনির্ধারকদের এবং সিএনজি, এলপিজি গ্যাসের সরবরাহকারীদের উদ্দেশ করে অনুরোধ জানাব যে পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের যথাযথ স্থানে এবং সিএনজি, এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডারে ভরার আগেই গন্ধ দেওয়ার রাসায়নিক মেশানোর ব্যবস্থা করুন এবং তা এখনই। এক মুহূর্ত দেরি করার সময় নেই। এর প্রযুক্তি উন্নত বিশ্বে সবার জানা এবং দেশের বিশেষজ্ঞরাও আমার এ লেখাটি পড়ার পর স্মৃতি থেকে নিশ্চয়ই খুঁজে বের করতে পারবেন।
যাঁরা দীর্ঘ সময় বা অনেক দিন পর বাইরে থেকে বাড়িতে ফেরেন, তাঁদের উচিত হবে প্রথমেই রান্নাঘরের সব দরজা-জানালা খুলে দেওয়া, যেন গ্যাস জমে থাকলেও তা বাইরে ছড়িয়ে যায়। এ জন্য কিছু সময় দিন, কিন্তু তাড়াতাড়ি করার জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ভুলেও চালু করবেন না।
সাধারণ পাঠকদের জন্য আর একটু তথ্য দিচ্ছি। দরজা-জানালা বন্ধ থাকলে জমে যাওয়া এ গ্যাস আগুনের ছোট একটি স্ফুলিঙ্গ পেলেই ভয়ংকর বোমার মতো কাজ করে। বিদ্যুতের লাইট, ফ্যান বা অন্যান্য যেকোনো যন্ত্রপাতির সুইচ অন-অফ করলে সেখানে ছোট একটি স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়, যা অনেক সময় দেখা যায় না, কিন্তু জমে থাকা গ্যাসে তা বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। এমনকি ব্যাটারির টর্চলাইটের সুইচেও স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতে পারে। আর দেশলাই বা সিগারেটের লাইটারের আগুনে তো কথাই নেই। তবে মুঠোফোনের টর্চলাইটটি নিরাপদ, কারণ এটি ইলেকট্রনিক সুইচের মাধ্যমে অন-অফ করা হয়, যাতে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় না।
তাই যাঁরা দীর্ঘ সময় বা অনেক দিন পর বাইরে থেকে বাড়িতে ফেরেন, তাঁদের উচিত হবে প্রথমেই রান্নাঘরের সব দরজা-জানালা খুলে দেওয়া, যেন গ্যাস জমে থাকলেও তা বাইরে ছড়িয়ে যায়। এ জন্য কিছু সময় দিন, কিন্তু তাড়াতাড়ি করার জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ভুলেও চালু করবেন না। অন্ধকার ঘর হলে মুঠোফোনের টর্চ ফেলে দেখুন, কিন্তু অন্য কোনো লাইট নয়।
জমে থাকা গ্যাসে বিস্ফোরণের এই সহজ প্রতিরোধের বিষয়টি দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবারই জানা দরকার। গ্যাস সরবরাহকারী সরকারি-বেসরকারি করপোরেশন বা কোম্পানি সবাইকেই এ জন্য দায় নিতে হবে ও জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি দুর্ঘটনা বলে মেনে নেওয়ার মানসিকতা পরিবর্তন করে কীভাবে নিজেকে ও আশপাশের সবাইকে বাঁচাতে পারি, তা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সংবাদমাধ্যম এবং ভোক্তা অধিকার সমিতিগুলোকেও অনেক সরব থাকতে হবে।
ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রব্বানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
[email protected]