ভারতে গরু নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ রাজ্যে গরু যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে, এ রকম নজির বোধ হয় আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভারতের তথ্য বিশ্লেষণকারী সাইট ইন্ডিয়া স্পেন্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতের গরু–সংশ্লিষ্ট ১২০টি সহিংস ঘটনায় ৪৫ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে উত্তর প্রদেশ রাজ্যে। সেখানে গরু–সংশ্লিষ্ট সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৯টি। আর এসব ঘটনায় মারা গেছে ১১ জন।
পুলিশ কর্মকর্তা সুবোধ কুমার সিং ওই ১১ জনের একজন। গত ৩ ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহর জেলায় গোরক্ষাকারীদের হামলায় সুবোধ কুমার ও ২০ বছর বয়সী আরেক যুবক নিহত হন। হামলাকারীদের মধ্যে অনেকে ছিলেন কট্টর ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর সদস্য। ওই জেলার একটি গ্রামে গরু হত্যা বন্ধ না করতে পারার জন্য তারা পুলিশকে অভিযুক্ত করে। তারা দাবি করে, ওই গ্রাম থেকে তারা গরুর দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে।
দেখা যাচ্ছে, গরু হত্যার গুজব যখন উঠছে তখন আইনের রক্ষাকারী একজন কর্মকর্তাও নিরাপদ নন। ঘটনাক্রমে সুবোধ কুমার সিং ছিলেন ২০১৫ সালে খুন হওয়া মোহাম্মদ আখলাক হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী কর্মকর্তা। গরু জবাই করে এর মাংস খাওয়ার অভিযোগ এনে গোরক্ষাকারীরা তাঁকে হত্যা
করেছিল। সুবোধ কুমার সিংয়ের বোন সরোজ সিং চৌহানের ধারণা, তাঁর ভাই রাজ্য পুলিশের ষড়যন্ত্রের শিকার, কেননা তিনি আখলাক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছিলেন। সরোজ সিং অভিযোগ করেন, রাজ্য পুলিশ গোরক্ষাকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর ভাইকে হত্যা করেছে।
সরোজ সিংয়ের এ অভিযোগ এই ইঙ্গিতই দেয় যে উত্তর প্রদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করছে এবং তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি সম্প্রসারণে সহায়তা করছে। বুলন্দশহরে সুবোধ সিং হত্যাকাণ্ডের পরদিন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রাজধানী লক্ষ্ণৌতে এক বৈঠকের আহ্বান করেন। স্থানীয় পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, তিনি সেখানে গরু হত্যার অভিযোগ এবং অবৈধ কসাইখানার ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দিলেও সুবোধ সিং হত্যার ব্যাপারে কোনো কিছুই বলেননি।
এর এক দিন পর উত্তর প্রদেশ পুলিশের মহাপরিচালক ওম প্রকাশ সিং বুলন্দশহরের ঘটনাকে ‘বড় ষড়যন্ত্রের অংশ’ বলে বলে বর্ণনা করেন। তিনি সেখানে গোহত্যা কীভাবে সংঘটিত হলো, সেই ঘটনা তদন্ত করার নির্দেশ দেন, সহিংসতায় দুজন নিহত হওয়ার ঘটনার নয়।
পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের এসব তদন্তের নির্দেশ ন্যায়বিচার না হওয়ার আশঙ্কারই জন্ম দেয়। সুবোধ সিং হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে একটি গ্রাম থেকে চারজন মুসলমান ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়, যে গ্রামটির অবস্থান গরু হত্যার ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। তবে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
আশঙ্কা করা হচ্ছে সুবোধ সিং হত্যাকারীদের বিচার কখনোই হবে না। একই ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করে ৮২ জন সাবেক সরকারি আমলা ইতিমধ্যে এক খোলা চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের পদত্যাগ দাবি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বুলন্দশহরের ওই ঘটনা সাংবিধানিক মূল্যবোধগুলোর সম্পূর্ণরূপে পতনের নির্দেশক। আর যোগী আদিত্যনাথ এর প্রতিনিধিত্ব করছেন, যিনি গোঁড়ামিকে তাঁর পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁরা দাবি করেন, মুখ্যমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড ‘আইনের শাসনহীনতাকে’ উৎসাহিত করছে।
এই আমলারা বুলন্দশহরের ঘটনাকে মুসলমানদের আরও দমিত করে এবং ভয়ের মধ্যে রাখার জন্য একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। তাঁদের মতে, ভারতে মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য এটা একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এ পর্যন্ত গোহত্যা–সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় যত জন নিহত হয়েছে, তার অর্ধেকেরই বেশি হচ্ছে মুসলমান। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো গরুকে ভীতি প্রদর্শন ও দমন করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার, সংখ্যালঘুরা তাদের পরিচয় হারিয়ে ফেলুক অথবা তারা মরে যাক। হিন্দুত্ববাদীরা চাইছে সংখ্যালঘুরা এটা অনুভব করুক যে তারা সংখ্যালঘু।
বর্তমানে ভারতের ২৪টি রাজ্যে গরু হত্যা ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য বিভিন্ন রাজ্যের আইনে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের হিন্দুত্ববাদীরা সে রাজ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ানোর জন্য এ নিষেধাজ্ঞাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। যদি উত্তর প্রদেশ রাজ্য প্রশাসন এসব নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সরব না হয় তাহলে সাংবিধানিক নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বি আর আম্বেদকার ১৯৪৯ সালে সাংবিধানিক পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, সাংবিধানিক অধিকার কোনো স্বাভাবিক অনুভূতি নয়। এটার চর্চা ও পরিমার্জন করতে হয়।
আমি বলতে চাই, সাম্প্রদায়িকতাও কোনো স্বাভাবিক অনুভূতি নয়। ধর্মনিরপেক্ষ আইনের ধারণাকে খর্ব করার জন্য এটা রাজনৈতিক নকশার দ্বারা উদ্ভূত। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এই সাম্প্রদায়িকতা কঠোর হাতে রুখতে হবে। গোহত্যা বন্ধের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: রোকেয়া রহমান
মানস ফিরাক ভট্টাচার্য ভারতীয় কবি ও লেখক