শিশুটির বয়স ১০। নাম চাঁদনি খাতুন। ধারণা করি, জন্মের পর তাকে চাঁদের সঙ্গে তুলনা করেই এই নাম দেওয়া হয়েছিল। এই বয়সে তার স্কুলে পড়ার কথা। ছোটাছুটি করে করে ঘর মাতিয়ে রাখার কথা। কিন্তু অভাবের সংসারে নিজের জন্য দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতেই তার ১০ বছরের কচি শরীর ঠাঁই পেয়েছিল ঢাকা শহরের এক বাসায়, গৃহশ্রমিক হিসেবে। জীবনের তাগাদা ছিল খেয়েপরে বেঁচে থাকা শুধু। কিন্তু সেটিও মেলেনি। উল্টো ঢাকায় আসার নয় মাস পর শরীরে দগদগে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কুষ্টিয়ার বাড়িতে ফিরে এসেছে সে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চার দিন পর থেকেই তার ওপর তার গৃহকর্ত্রী লিছা নির্যাতন শুরু করেন। ঘরের সব কাজ যেমন, থালাবাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা—সব তাকেই করতে হতো। কাজে একটু ভুল হলেই কথায় কথায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হতো। লোহার খুন্তি গরম করে ছেঁকা দেওয়া হতো। রাতে মারপিটের পর ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে ঘরের মেঝের ওপর ফেলে রাখা হতো।
অন্যদিকে, মেয়ের শ্রমের বিনিময়ে মাসে মাসে তার পরিবারকে দেওয়ার কথা থাকলেও একটা টাকাও দেননি গৃহকর্ত্রী। এমনকি গত নয় মাসে চাঁদনির পরিবারকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করতে দেননি। (প্রথম আলো, ১১ মার্চ ২০২১)। শুধু চাঁদনিই নয়, এ ধরনের গৃহশ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা আমরা প্রায়ই শুনি। হয়তো অনেক বেশি শুনি বলে এগুলো নিয়ে অনেকেই এখন আর ভাবেনও না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হরহামেশাই গৃহকর্মী নির্যাতন বিষয়ে অনেকেই লেখেন এবং অভিযোগ করেন। গত বছরও আমরা দেখেছি একজন গৃহকর্ত্রী তাঁর গৃহকর্মীকে বারান্দার কার্নিশে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ২২ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়ে নিহত হয়েছেন ১০ জন। ১৩ থেকে ১৮ বছরের গৃহশ্রমিকেরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন। এরপর আছে ৭ থেকে ১২ বছরের শিশুরা।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে গৃহকর্মী সুরক্ষা এবং কল্যাননীতি (২০১৫) করেছে, যা ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত ফাইলবন্দীই রয়েছে। এই নীতির ৭.৩ ধারা অনুযায়ী ১২ বছর বয়সী গৃহকর্মী শুধু এই ‘হালকা ধরনের কাজ’–এর জন্য বৈধ অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপ করে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারার কথা উল্লেখ আছে। তবে ‘এই হালকা’ কাজ কী, তা উল্লেখ করা হয়নি। ১২ বছরের আগে কোনো শিশুকে গৃহকাজে নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই এই নীতিমালা অনুযায়ী। কিন্তু আমরা অনেক সময়ই দেখি, একটি বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে আরেকটি শিশুকে কোলে রাখছে। আমরা পরিচিত কয়েকজনকেই জিজ্ঞেস করলে উত্তর হিসেবে জানলাম, ‘বাচ্চার সঙ্গে খেলার জন্য আনা হয়েছে শিশুটিকে’। যদি তা–ই হয়, তাহলে তো বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার দায়িত্ব তার হতে পারে না। কারণ, সে নিজেই শিশু।
আমাদের চারপাশে অনেক কর্মজীবী মা–বাবা আছেন, যাঁরা চাঁদনির মতো বয়সী শিশুর কাছে আরেকটি শিশুকে দেখভালসহ পরিবারের অন্যান্য কাজের দায়িত্ব দেন। ঘরে এসে আবার কাজ যদি একটু এদিক-ওদিক হয়, তাহলে নিপীড়ন করেন। অনেকেই আবার আরেক কাঠি ওপরে। নিজেই নির্যাতন করে থানায় গিয়ে শিশুটির নামে চুরি করা মিথ্যা অভিযোগও দিয়ে আসেন। দূরে যেতে হয়নি কাছেই শুনেছি, গৃহকর্মীর এত সুন্দর নাম হবে কেন?—এ জন্য গৃহকর্মীর নাম পাল্টে দিয়েছিলেন একজন নিয়োগকর্ত্রী। মেয়েটি মা–বাবার রাখা নামের পরিবর্তে ‘নতুন’ নাম নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে মারধর করা হয় এবং মেয়েটি সেখান থেকে দেয়াল টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিল। সেই মেয়েটির বয়সও ছিল ১০ বছর। আমাদের কত কিছু নিয়ে আপত্তি! ‘নিম্নশ্রেণির’ সবই যে আমাদের অপছন্দের! তবু তাদেরই আমাদের দরকার হয়। তাদের ছাড়া জীবন অচল—এটি আমরা মানতে নারাজ। তাদের শ্রমের ওপর ভিত্তি করেই টিকে আছে আমাদের আরাম–আয়েশের বেসাতি। আমরা এসব কিছুই মানতে চাই না।
২০১৫ সালে তৈরি করা সেই নীতিমালায় গৃহকর্মীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, তাঁদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ, নির্যাতন না করা, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভরণপোষণ, ছুটি ও প্রণোদনাসহ আরও সুবিধাদির কথা স্পষ্ট করে বলা আছে। আরও বলা হয়েছে, অসুস্থ সময়ে গৃহকর্মীদের কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং তাঁর চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিয়োগদাতার।
৭.১০. খ ধারায় আছে, গৃহকর্মী নিয়োগকর্তা তার পরিবারের কোন সদস্য দ্বারা শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, অশ্লীল আচরণ কিংবা যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতন কিংবা কোনো ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শনের শিকার হলে দেশের প্রচলিত আইনে সেটির ব্যবহার নেওয়া হবে। কিন্তু কার্যত আমরা এর কোনোটির প্রয়োগই খুব বেশি দেখি না। কারণ, এই নীতিমালা এখনো আইন হিসেবে হয়ে ওঠেনি।
এ ছাড়া বাংলাদেশের বেশির ভাগ গৃহকর্মীর জন্য কোনো ধরনের কর্মঘণ্টা নির্ধারিত নেই। পরিবারের সকলে ঘুম থেকে ওঠার আগে এই গ্রহশ্রমিকদের উঠতে হয় এবং তাঁরা ঘুমাতে যান সবাই ঘুমানোর পর। শ্রম আইন অনুযায়ী আট ঘণ্টা কাজ করার নিয়মের বালাই নেই তাঁদের জন্য। নেই কোনো ন্যূনতম বেতনকাঠামো।
তাই শিগগিরই গৃহকর্মী সুরক্ষা এ কল্যাণনীতিটি আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। হয়তো তাতেও থামবে না নিপীড়ন; তবু কিছুটা আস্থার জায়গাও তৈরি হবে। একটু খাবারের আশায় চাঁদনিদের হাড়-মাংস খুলে যায়, চামড়ায় ছেঁকা পড়ে...এভাবেই জীবন বেঁচে থাকে নিপীড়নের দগদগে ক্ষত নিয়ে।
জোবাইদা নাসরীন শিক্ষক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]