রিয়াজুল ইসলাম ও রাশেদ করিম দুই ভাই দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা ১১ জুন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিল অসুস্থ মাকে নিয়ে। তাদের বাবা কর্মহীন, নেই তেমন জমিজিরাতও। অভাবের সংসারে রিয়াজুল বড় ছেলে। সে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। রাশেদ করিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী।
গ্রামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে মায়ের চিকিৎসা করাতে তারা এসেছিল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে ভর্তি ফি ৩০ টাকা হলেও জোর করে জরুরি বিভাগ ১০০ টাকা নিচ্ছিল। তারা অতিরিক্ত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। টাকা ফেরত না পেয়ে তারা রসিদ চেয়েছিল। এ কারণে জরুরি বিভাগের কর্মচারীদের নির্মম মারধরের শিকার হয় রিয়াজুল ও রাশেদ। রিয়াজুল ইসলাম এক কানে ভালো শুনতে পাচ্ছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে চাইলেও তা করেনি। রিয়াজুলদের মায়ের চিকিৎসারই টাকা নেই, নিজেদের চিকিৎসা হবে কীভাবে? রিয়াজুল ইসলাম কাঁদতে কাঁদতে সেদিনের বর্ণনা দিচ্ছিল আর বলছিল, ‘আল্লাহর রহমত, মা এখনো হার্ট অ্যাটাক করেনি।’
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ এবং ভোগান্তি দূর করার জন্য ‘প্রতিবাদী রংপুর’–এর আয়োজনে একটি গোলটেবিল বৈঠক সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে রিয়াজুল ইসলাম বলে, ‘আমার অসুস্থ মা সন্ত্রাসীদের পা ধরে কাঁদলেও সন্ত্রাসীরা মারা বন্ধ করেনি।’ এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার কোনো প্রতিবেদন নেই।
রিয়াজুলদের দুই ভাই শুধু নয়, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রার্থীদের অনেকেই কমবেশি এমন পরিস্থিতির শিকার।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সহকর্মী উমর ফারুক রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। এক সহকর্মীর মা গুরুতর অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যান। তবু ভালোবাসা আর আবেগের জোরে উমর ফারুকেরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মৃতদেহ হাসপাতালের ট্রলি থেকে নামানোর সময় কর্মচারীরা উমর ফারুকের কাছে ৫০০ টাকা না নিয়ে নামাতে দেননি। কয়েক দিন আগে একজন কর্মচারী জ্বরে আক্রান্ত এক ব্যক্তির বাসায় গিয়ে করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করে ২০০ টাকা বেশি নিয়েছিলেন। আমি ওই ব্যক্তিকে ফোনে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে পরে তিনি রোগীকে ২০০ টাকা ফেরত দিয়ে আসেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। শৌচাগারে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। অনেক বাথরুমে লাইট নেই। মশার অত্যাচারে ঘুমাতে পারেন না রোগীরা। কয়েক দিন আগে সিসিইউয়ে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) প্রবেশ করে আমার চোখ চড়কগাছ। ১০ শয্যাবিশিষ্ট বড় কক্ষ। সার্বক্ষণিক শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে কক্ষটিতে কোনো জানালা রাখা হয়নি। পাঁচটি বড় বড় এসির একটিও চলছে না। একটি দরজার অর্ধেক বন্ধ। প্রচণ্ড দাবদাহের দিনেও বাইরের বাতাস আসার কোনো উপায় নেই, নেই ফ্যান কিংবা অন্য কোনো ব্যবস্থা। সোজা কথায় একটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে এই সিসিইউ। জানতে পারি, এক বছর ধরে সেগুলো নষ্ট হয়ে আছে। হৃদ্রোগের চিকিৎসাকেন্দ্রেরই বেহাল অবস্থা। সিসিইউকেই এখন আইসিইউয়ে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) নেওয়া জরুরি।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যত বড় সিন্ডিকেটই থাকুক না কেন, প্রশাসন চাইলে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে হাসপাতালটিকে জনসেবার অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে। তা না হলে চিকিৎসক বাড়িয়ে আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেও সেবার মান বৃদ্ধি পাবে না। এমনকি দেশজুড়ে স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়নের গল্পই গালগল্প হয়ে থাকবে।
সিসিইউয়ের ভেতরে কোনো শৌচাগার নেই। একজন রোগীকে নার্স জানালেন, পট কিনে এনে পর্দা টেনে দিয়ে ওখানেই শৌচকার্য করাতে। পোস্ট সিসিইউয়ে শৌচাগার থাকলেও সেখানে আলোর ব্যবস্থা নেই। সিসিইউর চিকিৎসকদের বেশ তৎপর এবং আন্তরিক মনে হয়েছে। ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেলেও চোখে-মুখে কোনোরকম বিরক্তি-ক্লান্তি না দেখিয়ে তাঁরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। এর কয়েক দিন পরই প্রথম আলোয় বার্ন ইউনিটের এসিগুলো অচল থাকার খবর প্রকাশিত হলে তখন বার্ন ইউনিটসহ অন্য সব এসি কর্তৃপক্ষ মেরামত করেছে।
রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র এই হাসপাতাল। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। হাসপাতালটিরই চিকিৎসা প্রয়োজন। শুধু চিকিৎসক ভালো হলেই সেবা পাওয়া যাবে না। সেবার জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন জরুরি। এর জন্য হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
হাসপাতালে দালাল চক্র দমনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে আর দালাল চক্র সেখানে গড়ে উঠতে না পারে। যেসব কর্মচারী এর সঙ্গে জড়িত, তঁাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যেকোনো রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অসাধু সন্ত্রাসী কিংবা দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যত বড় সিন্ডিকেটই থাকুক না কেন, প্রশাসন চাইলে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে হাসপাতালটিকে জনসেবার অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে। তা না হলে চিকিৎসক বাড়িয়ে আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেও সেবার মান বৃদ্ধি পাবে না। এমনকি দেশজুড়ে স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়নের গল্পই গালগল্প হয়ে থাকবে।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক