‘শি হ্যাজ নো বিউটি অর ফিজিক্যাল অ্যাট্রাকশন’, অর্থাৎ মহিলার কোনো সৌন্দর্য বা শারীরিক আকর্ষণ নেই। একটি গণধর্ষণ মামলার তিনজন আসামিকে জামিন দিয়ে অভিযোগকারী নারী সম্পর্কে এ মন্তব্য করেছিলেন একজন বিচারক।
ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মামলাটিকে ‘মিথ্যা’ বলে ২০১৬ সালের অক্টোবরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনে মন্তব্যটি উদ্ধৃত করে তিনি লেখেন, আদালত আসামিদের জামিননামার আদেশে এ কথা লিখেছেন।
আইও লিখছেন, ‘আসামিদের বয়স বিবেচনায় বিজ্ঞ আদালত তাহাদের রিমান্ড মঞ্জুর না করিয়া জামিনে মুক্তি প্রদান করতঃ’ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য
তাঁর কাছে পাঠান। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘আসামিরা প্রত্যেকেই পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং দুইজন আসামির পাকা দাড়ি রয়েছে।’
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৪-এ সরাসরি মামলাটি করেছিলেন একজন পোশাকশ্রমিক। অভিযোগ, আসামিদের একজন বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছিলেন। বিয়ের জন্য চাপ দিলে তিনি সবান্ধব মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন।
মেয়েটি নিজের বয়স লিখেছিলেন ৩৪ বছর। ঘটনার তারিখ লিখেছিলেন ১৯ মার্চ ২০১৬। তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা হয় ২৫ এপ্রিল, অর্থাৎ ৩৬ দিন পর। ফরেনসিক ডাক্তার যৌন সংগমের চিহ্ন পান, বয়স লেখেন ২২ বছরের বেশি। আর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আছে, আসামিদের জামিননামার আদেশে আদালত বলেছেন ভিকটিমের বয়স ৪৫। আইওর সিদ্ধান্ত, এটা ‘সাজানো’ মামলা, একটি বাসস্ট্যান্ডের চাঁদার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে করা।
এই লেখা অবশ্য মামলার সত্য-মিথ্যা নিয়ে নয়। আমি দুশ্চিন্তায় আছি আসামিদের জামিনদাতা বিচারক আর তদন্ত কর্মকর্তার মন্তব্যগুলো নিয়ে। নারী আর নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে আমাদের মনের গভীরে যে চিন্তাচেতনা গেড়ে বসে আছে, মন্তব্যগুলোতে তারই ছায়া দেখি। এমন মানসিকতা, চিন্তাধারা নিশ্চয় এ ধরনের মামলার তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়াকে কমবেশি প্রভাবিত করে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানী দল মে ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ছয়টি গুরুতর অপরাধের অভিযোগে আসা মামলার বিচার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছে। অপরাধগুলো হলো ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু ও হত্যা, গণধর্ষণ (মৃত্যু-হত্যাসহ), সম্ভ্রমহানির প্রত্যক্ষ কারণ ঘটিয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌনপীড়ন এবং যৌতুকের জন্য হত্যা বা হত্যাচেষ্টা।
প্রায় ১৫ বছরে আসা আট হাজারের কাছাকাছি মামলার বিচার-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি আমরা ৬৫টি মামলার নথিপত্র খুঁটিয়ে দেখেছি। অনেকগুলো মামলায় জড়িত মানুষজনের কাছে গিয়েছি। কথা বলেছি পুলিশ, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, মানবাধিকার আইনজীবী আর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।
অনেক নথিপত্রের ভাষায় আর বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপে মামলা সম্পর্কে আবছা থেকে সুস্পষ্ট অবিশ্বাস এবং অভিযোগকারী নারী বা শিশু-কিশোরের দোষ খোঁজার প্রবণতা টের পাওয়া যায়। প্রথম আলোয় ৮ মার্চ থেকে ২৩ মে ছয়টি পর্বে প্রকাশিত লেখাগুলোয় বিষয়টি নানাভাবে এসেছে।
২০১১ সালে তিনজন ‘আদম ব্যবসায়ী’র বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগে ৩ নম্বর ট্রাইব্যুনালে সরাসরি মামলা করেছিলেন এক নারী। আদালত কোতোয়ালি থানাকে তদন্ত করতে বলেন। মামলাটি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে করা—এই বলে তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তিনি লেখেন, অভিযোগকারিণীর ডাক্তারি পরীক্ষায় যৌন সংগমের চিহ্ন থাকার কথা ছিল কিন্তু জোরজবরদস্তির কথা ছিল না। পরীক্ষা হয়েছিল ঘটনার ১১ দিন পর।
আইও লিখেছেন, তিনি ওই নারীকে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর তাঁর হদিস পাননি। সাক্ষীদের পাননি। তাঁর মন্তব্য ‘বাদিনী দুর্ধর্ষ চালাক প্রকৃতির মহিলা’, আসামিদের সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য মামলাটি করেছেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আইও ‘চাতুর্যতা’র বিষয়টি যথেষ্টই ফেনিয়েছেন।
২০০৩ সালে উত্তরা থানায় একজন পোশাকশ্রমিক পরিচিত দুই যুবকের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের মামলা করেছিলেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় সাম্প্রতিক জোরপূর্বক সংগমের আলামত পাওয়া যায়। পরনের সালোয়ারে ‘মানুষের বীর্য’ পাওয়া যায়। মামলাটির আইও আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। কিন্তু তাতে তিনি ‘প্রকাশ্য ও গোপন’ তদন্তের বরাত দিয়ে এ কথাও লেখেন যে ‘ভিকটিম একজন স্বামী-পরিত্যক্তা গার্মেন্টসকর্মী’। আসামিদের সঙ্গে তার ‘সুসম্পর্ক গড়িয়া উঠে এবং ১ নম্বর ও ২ নম্বর আসামি বিবাহিত হইলেও’ দুজনই মেয়েটিকে ‘ভালোবাসত’। তারা মেয়েটিকে ‘বিভিন্ন স্থানে নিয়া অসামাজিক কাজকর্ম করিত’।
এই মামলার সাক্ষ্য-শুনানি হলে আসামিপক্ষের উকিল যথারীতি সাক্ষ্য আইনের বিতর্কিত ১৫৫(৪) ধারার বলে মেয়েটির চরিত্র তুলে হেনস্তা করার ভালোই সুযোগ পেতেন। কিন্তু ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালে মামলাটির অভিযোগ গঠিত হতে ছয় বছর লেগে যায়। পরের ছয় বছরে রাষ্ট্রপক্ষ একজন সাক্ষীকেও হাজির না করায় বিচারক পলাতক আসামিদের খালাস দেন।
বেশির ভাগ ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলা এসেছে পোশাকশ্রমিক-অধু্যষিত এলাকাগুলো থেকে। মনে পড়ছে, সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল কাদির প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এখানে নারী শ্রমিকেরা স্বাধীন জীবন যাপন করে, নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেয়। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে থাকে।’ কথাগুলো আপাত–সহানুভূতিশীল। কিন্তু নারীর জীবনযাপন, চলাফেরা সম্পর্কে কটাক্ষ স্পষ্ট।
২০০৬ সালে ধামরাই থানায় একজন উপপরিদর্শকের (এসআই) এজাহারে একটি আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা হয়েছিল। অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগে সামাজিক বিচারে এক নারীকে বেত্রাঘাত করে মাথার চুল কেটে দিলে তিনি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। একই এসআই মামলাটির তদন্ত করে সালিসকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। সেখানে মেয়েটির ‘অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত অবস্থায়’ ধরা পড়ার কথা আছে। আইও আরও লিখেছেন, ‘মেয়েটির অতীত চরিত্র ভালো নয় বলে তার পরিবার তাকে পাত্রস্থ করার উপায় না দেখে এই ধরনের পাগলের সহিত বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তার স্বামী পাগল হওয়ার সুযোগে প্রায়ই সে অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত ছিল।’
কেরানীগঞ্জ থানায় ২০০৪ সালে যৌতুকের জন্য হত্যার একটি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা নিহত মেয়েটির স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। তবে তিনি লেখেন, স্ত্রী প্রায়ই অসুস্থ থাকায় স্বামী তাঁর চিকিৎসার জন্যই টাকা আনতে চাপ দিতেন। ঘটনার রাতেও স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন। স্বামী তাঁকে ‘সামান্য মারধর’ করেন।
নারী ও নারী নির্যাতনসম্পর্কে মজ্জাগত মনোভাব অবশ্য সবচেয়ে প্রকট যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে। অনানুষ্ঠানিক আলাপে ‘স্বাধীন’, ‘আধুনিক’ মেয়ে সম্পর্কে তির্যক কথাবার্তা অনেক শুনেছি, সে দরিদ্র হোক বা ধনী। ১৯ এপ্রিল ধর্ষণ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের পর প্রথম আলো নিজের ফেসবুক পাতায় পাঠকের কাছে প্রতিকারের পরামর্শ চেয়েছিল। অনেক পাঠকই ধর্ষণকারীর শাস্তির পাশাপাশি মেয়েদের সংযত হয়ে পর্দা মেনে চলতে বলেছেন। সেই আদি তত্ত্ব, ‘মেয়েরা তেঁতুলের মতো’!
আবার নথিপত্রে আসামিদের ‘নারীলোভী’ বা ‘প্রতিনিয়ত নারী ধর্ষণের সাথে জড়িত’ বলার নজির আছে। পুরুষের ‘যৌন সুখানুভূতি লাভের আকাঙ্ক্ষা’ নিয়েও কথাবার্তা আছে। যৌন নিপীড়নকারী এক মুরব্বিকে কারাদণ্ড দিয়ে বিচারক লিখেছেন, ‘বর্ষা শেষে শরৎ আসিলে বর্ষা যেমন একেবারেই শেষ হইয়া যায় না, তেমনি পুরুষের বয়স ৬০ বছর হইলেই যৌন কামনা চরিতার্থ করিবার আকাঙ্ক্ষা চিরতরে শেষ হইয়া যায়—এইরূপ বিশ্বাস করিবার কোনো কারণ নাই।’
এমন নাটকীয় অথবা রসাল বর্ণনা তেঁতুল-তত্ত্বেরই উল্টো পিঠ মাত্র। তবে তেঁতুল-কথা তো মনের ওপরের স্তরে ভেসে ওঠা ময়লা। এর ভিত্তিতে আছে নারীকে ছোট ভাবার, পুরুষেতর ভাবার, মানবেতর ভাবার মানসিকতা। সহিংসতা আর বিচারহীনতার শিকড় সেখানে। প্রতিকার চাইলে সেখানেই বদল আনতে হবে। বদলের শিক্ষা শুরু হতে শিশুকালে বোধবুদ্ধি বিকাশের সময়। কিন্তু পক্ববুদ্ধির মানুষজনকেও তো শিখতে হবে। ভাবতে হবে, ‘গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে!’
কুররাতুল–আইন–তাহ্মিনা : সাংবাদিক