গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যায় রাষ্ট্রের দায়

বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের গুম হওয়ার ঘটনা বেশ প্রাধান্য পেয়ে চলেছে। গত ১৭ নভেম্বর ব্রিটেনের গার্ডিয়ান বলেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, গুমের ঘটনা ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও উদ্বেগজনক। ২০০৯ সালে ২ লাখ ৭৫ হাজার ব্রিটিশ নাগরিক গুম হন, এর মধ্যে ২০ হাজার লোক আর ফিরে আসেননি। আমেরিকার পরিস্থিতি আরও খারাপ। এ বিষয়ে গার্ডিয়ান ব্রিটিশ দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট-এর বরাতে বলেছে, গুমের ঘটনায় ব্রিটিশ সরকারের জড়িত থাকার কথা নেই।
১০ অক্টোবর ২০০৯ প্রকাশিত ইনডিপেনডেন্ট-এর ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘দ্য মিসিং: ইচ ইয়ার, ২,৭৫,০০০ ব্রিটনস ডিজঅ্যাপিয়ার’ (‘নিখোঁজ: প্রতিবছর ২ লাখ ৭৫ হাজার ব্রিটিশ নাগরিকের অন্তর্ধান’)। হারিয়ে যাওয়া মানুষের পরিসংখ্যান এবং তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কাজ করেন, এ রকম বহু দাতব্য বেসরকারি সংস্থা ব্রিটেনে সক্রিয় রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সরকারি নয়, ওই সব দাতব্য সংস্থার তথ্যভান্ডার কাজে লাগিয়েই সাংবাদিক ডেভিড র্যান্ডাল ও গ্রেগ ওয়ালটন ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
গত মাসের শুরুতে আমাদের পুলিশপ্রধান বলেছিলেন, গোপন অপহরণ দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা পুরোনো
এক প্রবণতা। যদি তা হয়, তাহলে এত দিনেও কেন আমরা বিশেষায়িত এমন কোনো বেসরকারি সংস্থাকে (আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ অন্য যারা প্রধানত পত্রিকা থেকে তথ্য সংকলন করে) এই কাজে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত হতে দেখছি না? কেবলই সম্পদের অভাবে? নাকি এ রকম কোনো বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করার মতো পরিবেশের অভাব আছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এর আগে বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করা এবং দেনা পরিশোধ করতে না পারার মতো ব্যক্তিগত বা সামাজিক কারণে আবার কিছু দাগি অপরাধীও নাকি ‘গা-ঢাকা’ দিচ্ছে। কেউ সুপরিকল্পিতভাবে নিজেকে আড়াল করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে করলে তো সেটি আরও গুরুতর অপরাধ। সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো, তাদের স্বেচ্ছায় গুম হওয়া তত্ত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা দেওয়া। এ কারণে বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও তার বিচার করা দরকার।
ব্রিটেনে প্রতিবছর আড়াই লাখ লোক হারিয়ে যাওয়ার তথ্য দাতব্য সংস্থাগুলো সংরক্ষণ করছে। কিন্তু ব্রিটেনে এভাবে লোক হারিয়ে যাওয়া আর বাংলাদেশসহ যেসব দেশে গুম বা এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের অভিযোগ তোলা হয়, তা এক নয়। ভিন্নমত দমন করতে রাষ্ট্র পদ্ধতিগতভাবে যখন কাউকে জবরদস্তিমূলকভাবে তুলে নিয়ে যায় এবং তাদের হদিস পাওয়া যায় না, তখন সেটা গুম।
ইনডিপেনডেন্ট-এর ওই রিপোর্টে ‘ডিজঅ্যাপিয়ার’ বা ‘অন্তর্ধান’ কথাটি আছে, কিন্তু ‘এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স’ কথাটি নেই। বরং বলা হয়েছে, ‘এভাবে পরিবার-পরিজন থেকে হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক মন্দা।’ ওই প্রতিবেদন বলেছে, ‘কর্মক্ষেত্রে চাপ, অর্থের সংকট (মন্দা অন্তর্ধান বৃদ্ধির বড় কারণ) বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া’ এসব অন্তর্ধানের কারণ। যারা হারিয়ে যায়, তারা ফিরে আসে, কিন্তু তাদের গরহাজির থাকার সময়টাতে স্বজনেরা উদ্বেগের মধ্যে থাকে, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না-এটাই ওই সমাজের উদ্বেগের বিষয়।
ব্রিটেনে যে প্রতি দুই মিনিটে একজন লোক হারিয়ে যায়, তার সঙ্গে আমাদের গুম পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। ইনডিপেনডেন্ট-এর ওই রিপোর্ট বলেছে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকেই দ্রুত ফিরে আসছে। আবার কিছু লোকের খোঁজ দশকের পর দশক ধরে স্বজনেরা পাচ্ছে না। সংসদে যাঁরা ইনডিপেনডেন্ট-এর ওই তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন, তাঁরা তাঁকে বিভ্রান্ত করেছেন বলে মনে হচ্ছে। কারণ, ব্রিটিশ পরিবারগুলো সেখানে স্বজনদের অন্তর্ধানের জন্য রাষ্ট্রকে দোষারোপ করছে না; সংবাদ সম্মেলন করছে না। বাংলাদেশি পরিবারগুলোর দুশ্চিন্তা আর ব্রিটিশ স্বজনহারাদের অসহায়তা এক নয়।
ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায়ে র্যাবের ১৫ জনের ফাঁসির দণ্ড হওয়ার সাড়াজাগানো রায়টির উল্লেখ করেছে। ২০১৪ সালের ওই ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মধ্য দিয়ে। বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপে এরপর আর কোনো তদন্তের কথা আমরা শুনিনি। গত জুলাইয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, গত বছর গোপনে আটক ৯০ জনের মধ্যে ২১ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবং আরও অন্তত নয়জন নিখোঁজ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রকৃত জবাবদিহি হতে পারে গ্রহণযোগ্য তদন্ত করে সেসবের রিপোর্ট প্রকাশ করা। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ২১ ডিসেম্বরের টুইটে ২০১৩ সালের ‘কৃষ্ণ ডিসেম্বরে’ ১৯ বিএনপি কর্মীর অপহৃত হওয়া এবং গত ১০ বছরে অন্তত ৭৫০ জন গণতন্ত্রপন্থীর নিখোঁজ হওয়ার তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির আন্দোলনের সময় পেট্রলবোমায় যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁরা যে কোন পন্থী ছিলেন, সেটা অবশ্য তঁারা কেউ বলে দিচ্ছেন না!
বেগম জিয়ার কথায়, ‘ওই ৭৫০ জনের ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিধ্বস্ত, এর অবসান দরকার।’ নিজে ক্ষমতায় গিয়ে কী করবেন, সে বিষয়ে অবশ্য তিনি এখনো পর্যন্ত কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা প্রকাশ করেননি। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সূচনা যে তিনিই করেছিলেন, সে বিষয়ে কিন্তু তিনি একেবারে নিশ্চুপ। সেসবের দায় নেওয়া বা সে জন্য দুঃখ প্রকাশের কোনোটাই তিনি করেননি। সরকারি মহল সাধারণত খালেদা জিয়ার কথার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে, কিন্তু তাঁর ওই টুইট নিয়ে কারও টুঁ শব্দটিও নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক গত সোমবার আমাদের এ অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বলেছে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৪০২ ব্যক্তি গুম হয়েছেন। কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়ার গতি যথারীতি শ্লথ। গুমের প্রবণতা আগের তুলনায় ‘কিছুটা বেড়েছে’। নভেম্বর পর্যন্ত নিখোঁজ/গুম/বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৬৭টি। এর মধ্যে ২৯টি ঘটনায় মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করতে বলা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো একটি ঘটনারও তদন্ত হওয়ার ব্যাপারে কমিশন অবগত হয়নি।
২৪ ডিসেম্বর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনা হলো। গত বছরের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের দুটি ঘটনার তদন্ত করেছে। ঘটনা দুটিতে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। এর মানে একটা দায়মুক্তি চলমান। কিন্তু এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স অর্থে যে গুম, সে বিষয়ে কোনো সফল তদন্তের তথ্য আমাদের জানা নেই। মানবাধিকার কমিশনের উচিত, গুম বিষয়েও একটি কার্যকর তদন্ত করা।
মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি অবশ্য আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত যে গুম বা হারিয়ে যাওয়া মানুষ এবং তাঁদের স্বজনদের নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করার জন্য একটি সংস্থা থাকা উচিত। তিনি অবশ্য বলেছেন, চলমান শূন্যতা পূরণে কমিশন সীমিতভাবে নিজেই একটি উদ্যোগ নেবে। সাত সদস্যের কমিশন আইনের চোখে একটি দেওয়ানি আদালত। এই আদালতের সামনে ফিরে আসা শিক্ষক মোবাশ্বার ও সাংবাদিক উত্পলকে আজ বুধবার জবানবন্দি দেওয়ার জন্য কমিশন চিঠি দিয়েছে।
রাষ্ট্রের দায় মেটানোর প্রশ্নে সোভিয়েত অভিজ্ঞতা স্মরণ করি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যাঁরা প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে গণমৈত্রী) পড়তে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের কাছে ভ্লাদিমির কোত্সার একটি পরিচিত নাম। স্তালিনের আমলে পার্টির অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে ভ্লাদিমিরের মামা ইভানোভানা নিহত হন। কারাগারে কেজিবি এজেন্টরা তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। ১৯৪৩ সালে ওই হত্যাকাণ্ডের সময় তাঁর বোন সরকারের কাছ থেকে একটি মিথ্যা তথ্যসংবলিত চিঠি পেয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, তাঁকে শাখালিন দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঢাকায় সফররত ভ্লাদিমির তাঁর মস্কোর বাসায় আমাদের বলেছেন, ১৪ বছর পর, ১৯৫৫ সালে স্তালিনের মৃত্যুর মাত্র দুই বছরের মধ্যে রাষ্ট্র নিহত ব্যক্তির পরিবারকে চিঠি দিয়ে বলেছে, যে অভিযোগে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, তা যথার্থ ছিল না। রাষ্ট্র তাঁকে অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে। এ ঘটনা ঘটেছিল ভ্লাদিমিরের মায়ের বিয়ের আগে। ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ে কেউ প্রাণ হারালেই ঘটনা শেষ হয় না। পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যকে তার কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হয়। সোভিয়েত সমাজও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ভাইয়ের ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ কারণে ভ্লাদিমিরের মায়ের চাকরি যায়। ভ্লাদিমিরের বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া খেতাবপ্রাপ্ত যুদ্ধাহত জেনারেল। কলঙ্কিত ভাইয়ের বোনকে বিয়ে করতে গিয়ে তাঁকে সামরিক বাহিনীর অনুমতি নিতে হয়েছিল।
এই অন্যায্য ঘটনার দায় রাষ্ট্র স্বীকার করেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তঁার স্বজনদের একটা দায়মুক্তি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি ‘বেওয়ারিশ গুম’ হয়ে গেলে তার তো দায়মুক্তিরও কোনো রাস্তা থাকে না। আমাদের সমাজে এ রকম কোনো সংবেদনশীলতার উদ্বোধন দেখি না। স্বাধীনতার পর থেকে কত না ওজর-আপত্তিতে কত মানুষকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে, কে তার হিসাব রেখেছে?
রাষ্ট্রের কাছে তার তালিকা নেই। তার থেকেও বড় কথা, এসব বিষয় নথিবদ্ধকরণ বা এসবের দায়বোধ নিয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোতে কোনো আলাপ-আলোচনার সূত্রপাতেরও কোনো চিহ্ন দেখি না। এই দায় থেকে তাহলে আমরা রাষ্ট্রকে মুক্তি দেব কীভাবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]