গুপকর গ্যাং ও কাশ্মীরি গণতন্ত্রের নব অধ্যায়
সম্ভবত এই প্রথম কোনো ভোটের ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দুই যুযুধান শিবিরই নিজেদের জয়ী ঘোষণা করল। প্রায় এক মাস ধরে চলা জম্মু-কাশ্মীরের জেলা উন্নয়ন পর্ষদের (ডিডিসি) ভোটের ফল বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি এবং পিপলস অ্যালায়েন্স ফর গুপকর ডিক্লারেশন (পিএজিডি) দাবি জানাল, জিত তাদের। জনমত তাদেরই দিকে। এমন ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি।
প্রায় দেড় বছর আগে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত হয়। গঠিত হয় দুই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। একটি জম্মু-কাশ্মীর, অন্যটি লাদাখ। একই সঙ্গে বাতিল করে দেওয়া হয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ, যা ওই অখণ্ড রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। সেদিন থেকেই শুরু ব্যাপক ধরপাকড়। বড়, মেজো ও সেজো মাপের কয়েকশ নেতাকে গৃহবন্দী করা হয়। জারি হয় জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা। প্রায় দেড় বছরের মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো জেলা উন্নয়ন পর্ষদের ভোট গ্রহণের। উদ্দেশ্য দ্বিমুখী। গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি ও তৃণমূল স্তরের উন্নয়ন প্রকল্প চালু করা। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে আট দফায় অনুষ্ঠিত সেই ভোটের ফলে দেখা গেল, জম্মু বিভাগে বিজেপি তার আধিপত্য কিছুটা খুইয়েও অনেকটা বজায় রাখতে পেরেছে, কাশ্মীর উপত্যকার দখল নিয়েছে পিএজিডি জোট। এই প্রথম উপত্যকায় বিজেপি তার পদচিহ্ন রাখল ৩টি আসন জিতে, যার একটি শ্রীনগরে, জয় যদিও মাত্র ১৪ ভোটে।
শোচনীয় ফল বিজেপির উদ্যোগে গঠিত জম্মু-কাশ্মীর আপনি পার্টির। পিডিপি, কংগ্রেস ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিক্ষুব্ধদের সংগঠিত করে দলটি গড়া। মাত্র ১২টি আসন তারা জিতেছে। এদের নিয়ে অনেক আশার জাল বুনেছিল বিজেপি। এদের দিয়েই তারা কাশ্মীরকে তিন পরিবারের কবল থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল।
জম্মু-কাশ্মীরের মোট জেলা ২০ টি। জম্মুতে ১০ টি, কাশ্মীর উপত্যকাতেও ১০। প্রতিটি জেলায় ডিডিসির আসন রয়েছে ১৪টি করে। অঙ্কের সহজ হিসেবে তাই জম্মু ও কাশ্মীর দুই ডিভিশনের আসন ১৪০টি করে মোট ২৮০ টি। ভোটের ফল অনুযায়ী পিএজিডি পেয়েছে ১১০টি আসন, বিজেপি ৭৫, কংগ্রেস ২৬, আপনি পার্টি ১২, প্যান্থার্স পার্টি ২ ও বিএসপি ১ টি। জিতেছেন ৪৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীও, যাঁদের অধিকাংশ জোটের ‘প্রক্সি’ও বিক্ষুব্ধ। বোর্ড গঠনের আগে-পরে তাঁদের অনেকের জোটে যোগদানের সম্ভাবনা প্রবল।
বিজেপির কাছে এই ফল হতাশজনক। কিন্তু প্রকাশ্যে সেই হতাশা দেখানোর কোনো উপায় তাদের নেই। দলীয় নেতৃত্ব তাই সাফল্যের সাতকাহন রচনা করেছে। সেই উপাখ্যানে একক গরিষ্ঠ দল (৭৫) হওয়ার গরিমা রয়েছে, যদিও তারা সবার চেয়ে বেশি প্রার্থী (২৩০) দাঁড় করিয়েছিল। এই প্রথম উপত্যকায় পদ্মফুল ফোটানোর কৃতিত্বও জাহির হচ্ছে, যদিও প্রাপ্ত ভোটের হার যে মাত্র ৩ শতাংশ তা অনুচ্চারিত। প্রবল ঢক্কানিনাদ চাপা দিচ্ছে জম্মু ডিভিশনে পিএজিডির অভাবিত সাফল্যও। কংগ্রেসের সমর্থনে জম্মুর তিন জেলার বোর্ডও জোট দখল করতে পারে। জম্মু ও কাশ্মীরের মোট ২০ জেলার মধ্যে বিজেপি জিতেছে মাত্র ৬ টি। প্রতিটিই জম্মু বিভাগে। তুলনায় উপত্যকায় জোট এককভাবে ৯। কিন্তু তাতে কী? নির্বাচনী তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, যিনি এক বছর আগে শাহিনবাগের ‘গদ্দারদের’ গুলি মারার নিদান দিয়েছিলেন, তিনি বলেছেন, এই ফল বোঝাল, জম্মু-কাশ্মীরের জনতা প্রধানমন্ত্রীর জনমুখী শাসনকেই সমর্থন করছেন। উপত্যকায় তাই পদ্ম বিকশিত। বিজেপির জম্মুর নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, প্রমাণ হলো কাশ্মীরি জনতা প্রধানমন্ত্রীকে ভরসা করে। তারা উন্নয়নের পক্ষে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের দাবি, কাশ্মীরিরা সন্ত্রাসবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও চরমপন্থীদের সপাটে চড় কষিয়েছে।
২০১৯ সালের ৪ আগস্ট শ্রীনগরের গুপকর রোডে ফারুক আবদুল্লার বাড়িতে যে বৈঠকে সপ্ত দলীয় নেতারা রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা রক্ষার শপথ নিয়ে ‘গুপকর ঘোষণাপত্রে’ সই করেছিলেন, তাঁরাই জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
দেড় বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর সদম্ভ ঘোষণা ছিল, কাশ্মীরকে তিন পরিবারের মুঠো থেকে আজাদি দেবেন। কোন কোন পরিবার? ‘আবদুল্লা’, ‘নেহরু-গান্ধী’ ও ‘মুফতি’। শেখ-ফারুক-ওমর আবদুল্লার তিন প্রজন্মের ‘এনসি’, গান্ধীদের ‘কংগ্রেস’ ও মুফতি মহম্মদ-মেহবুবার ‘পিডিপি’র কবজা থেকে কাশ্মীরের রাজনীতি মুক্ত করে শাসনভার জনতার হাতে তুলে দেবেন। কারা সেই জনতা? বিজেপি সেটাও ঠিক করে দিল। দলছুটদের আশকারা দিয়ে গড়ে তোলা ‘আপনি পার্টি’ এবং তারা নিজে। শাসকের চাহিদা ছিল ২০১৯ সালে ৫ আগস্ট গৃহীত সরকারি সিদ্ধান্তে জনতার রায়ের সিলমোহর আদায়, যাতে দেশ ও দুনিয়াকে দেখানো যায় ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত ছিল ঠিক এবং জনতা তা অনুমোদন করছে। সে জন্য প্রয়োজন ছিল দুই ডিভিশনেই যথাসম্ভব জেলা দখল। দুর্ভাগ্য, বিজেপির সেই লক্ষ্য হাসিল হলো না। কিন্তু হার মানা তো চলে না। তাই সাফল্যের এত ঢক্কা নিনাদ।
সেই নিনাদে চাপা দিতে চাইছে তাদের ব্যর্থতা। ভোটের সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে, যাতে বলা হয়েছিল উপত্যকার সব দল ভোট বয়কট করবে। সেটা হলে কুড়ি জেলার নিয়ন্ত্রণই কেন্দ্রের হাতে চলে আসত। ফারুক আবদুল্লা (এনসি), মেহবুবা মুফতি (পিডিপি), সাজ্জাদ লোন (পিপলস কনফারেন্স), ইউসুফ তারিগামি (সিপিএম) ও গুলাম আহমেদ মীর (কংগ্রেস) বিজেপির সেই বাড়া ভাতে ছাই ফেলেন। ২০১৯ সালের ৪ আগস্ট শ্রীনগরের গুপকর রোডে ফারুক আবদুল্লার বাড়িতে যে বৈঠকে সপ্ত দলীয় নেতারা রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা রক্ষার শপথ নিয়ে ‘গুপকর ঘোষণাপত্রে’ সই করেছিলেন, তাঁরাই জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ধাক্কা সামলাতে হতচকিত বিজেপি চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। জোট নেতৃত্বের অভিযোগ, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তাঁদের প্রার্থীদের শিবিরে আটক রাখা হয়েছে। ইচ্ছামতো প্রচারে অনুমতি দেওয়া হয়নি। নানা আইনে প্রার্থীদের পর্যন্ত বন্দী করা হয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে শাসক দলের স্বার্থে। বহু পুরোনো দুর্নীতির অভিযোগ নতুন করে টেনে নেতাদের হেয় করা হয়েছে। দখল করা হচ্ছে সম্পত্তি। ভোটের পর তাঁদের নতুন আশঙ্কা বিজেপির ‘সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ’এর কৌশল ঘিরে।
দীর্ঘ বিরতির পর কাশ্মীরে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন অবশ্যই স্বস্তিদায়ক। সর্বদলীয় অংশগ্রহণ ভারতীয় সংবিধানের প্রতি আনুগত্যেরও প্রমাণ। পিএজিডি এই নির্বাচনকে রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা হরণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গণভোট বলে অভিহিত করেছে। প্রচারে এটিই ছিল তাদের একমাত্র বিষয়। ফল প্রকাশের পর সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ওমর আবদুল্লা বলেছেন, সরকার এবার ভুল শুধরে নিক।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের জবানিতে যারা ‘গুপকর গ্যাং’, বিজেপির অহর্নিশ প্রচারে যারা ‘পাকিস্তান ও চীনের দালাল’, যারা ‘রাষ্ট্রবিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী’, জম্মু-কাশ্মীরের জনতা অধিকাংশ জেলার ভার তাদের হাতেই ছেড়ে দিল। স্পষ্টত, গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের পাশাপাশি কাশ্মীরে রাজনৈতিক সংগ্রামের নতুন এক অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।
সৌম্য বন্দ্যোপধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি