২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

গিরিগুহা ও প্রবীণ সমাচার

মানবসভ্যতার ইতিহাসে গিরিগুহা পাহাড়-পর্বতের গুহা খুব চমকপ্রদ ও মজার জায়গাজুড়ে আছে। শীতের প্রকোপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর হিংস্র জন্তুদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য আদিম যুগে আদি মানব বসবাস করত গিরিগুহায়। প্রাচীন গ্রিসের উপাখ্যানে দেবরাজ জিয়ুস প্রমুখের বাসস্থান ছিল গিরিগুহায়। আর রোমানদের বিশ্বাস ছিল, গুহায় বাস করে জিন-পরি ও দানবেরা। প্রাচীন পারস্যবাসীরাও নাকি গিরি-কন্দরে আলোর দেবতাকে পূজা করত। এখন ওগুলো বিভিন্ন দেশে উৎসুক পর্যটকদের আকর্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাস্তবিকই গুহার ভেতরে অপার্থিব সৌন্দর্য ও বৈজ্ঞানিক বিস্ময় যুগে যুগে মানুষের মনকে আকর্ষণ করেছে। একদল মানুষই আছেন, যাঁদের প্রধানতম শখ গুহা আবিষ্কার ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। তাঁদের ইংরেজিতে বলা হয় স্পেলাংকর (Spelunker); এ সম্পর্কিত বিদ্যার নাম স্পেলিওলজি (Speliology)। আমাদের প্রধানতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বোধগম্য কারণে নিত্যনতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে; সুতরাং এ রকম একটি বিভাগ এল বলে! গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত এ দেশে উল্লেখযোগ্য গিরিগুহা নেই বলেই বোধকরি এযাবৎ এমন কোনো বিভাগ খোলা হয়নি, নতুবা খোলা হয়ে যেত।
তবে হ্যাঁ, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দুটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ গিরিগুহা আছে। একটি হলো গিয়ে অজন্তা, যেখানে গুহার দেয়ালে বিরাজ করছে অত্যাশ্চর্য রঙিন চিত্রাবলি। আর অপরটি হলো ‘ইলোরা’, যেখানে বিরাজ করছে গুহার ভেতর দেয়ালের পাথর কেটে খোদাই করা মূর্তি। ফি বছর আমাদের দেশ থেকেও অনেক দর্শক নাকি ওগুলো দেখতে ভারত ভ্রমণে যান।
অজন্তা-ইলোরার গিরিগুহা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি; তবে এবারের মার্কিন যাত্রায় ওখানকার অত্যন্ত বৃহৎ ও বিখ্যাত গিরিগুহা দর্শনের সুযোগ হয়েছে। ওটার নাম ল্যুরে কেভার্নস (Luray Caverns) এবং গুহাটি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া স্টেটে অবস্থিত ও এতটাই সুপ্রসিদ্ধ যে ফি বছর প্রায় পাঁচ লাখ দর্শনার্থী দর্শনির বিনিময়ে ওটা দেখতে যান। তো এ প্রসঙ্গে দুটো ইংরেজি শব্দের ব্যাপারে জ্ঞান থাকা দরকার—‘স্ট্যালাকটাইট (Stalactite) ও স্ট্যালাকমাইট (Stalacmite)। গুহার ছাদ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ে চুনাপাথরের যেসব ঝুলন্ত দণ্ড তৈরি হয়, সেগুলো হচ্ছে স্ট্যালাকটাইট, আর গুহার মেঝে থেকে স্তম্ভাকারে দণ্ডায়মান অনুরূপ দণ্ড হচ্ছে স্ট্যালাকমাইট। এ দুয়ের সম্মিলিত সৌন্দর্যই হচ্ছে গুহাভ্যন্তরে উপভোগের বিষয় এবং এটা অনুভবের ব্যাপার বর্ণনার নয়। এসব জায়গায় গেলে বিশ্বস্রষ্টার সৃষ্টির মাহাত্ম্য দর্শনে তদ্প্রতি শ্রদ্ধায়-মমতায় মাথাটা আপনাআপনি নত হয়ে আসে।
অবশ্য সত্যি কথা বলতে কি, আমি সবচেয়ে বেশি পুলকিত বোধ করেছি গিরিগুহাটির হাঁটা পথের শেষ প্রান্তে এসে। ওখানটায় বিরাজমান একটি অগভীর ইচ্ছাপূরণ কূপ, যেটার স্বচ্ছ পানিতে ঝলমল করছিল বিভিন্ন বিভাজনের হাজারো ধাতব মুদ্রা। দর্শনার্থীরা মনের ইচ্ছাপূরণার্থে মুদ্রাগুলো পানিতে ফেলেছে ও ফেলছে। তাদের ইচ্ছা পূরণ হোক আর না হোক, প্রতিবছরান্তে মুদ্রাগুলো কুড়িয়ে একত্র করে অনেক ডলার সে দেশের বিভিন্ন জনহিতকর প্রতিষ্ঠানকে দান করা হয়। একই ধরনের ইচ্ছাপূরণ কূপ আমি বিলেতে অবস্থানকালে দেখেছি ওখানকার বাথ শহরে। আর ফ্রান্সে প্রশিক্ষণকালে দেখেছি প্রেমিক-প্রেমিকারা ইচ্ছাপূরণের মান্নতে আইফেল টাওয়ারের বিপরীতে সিন নদীর তীরবর্তী লোহার রেলিংয়ে তালা সংযোগ করে চাবি নদীতে ফেলে দিতে। পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্যের লোকেরা, বিশেষত আমরা বাঙালিরা অনেক বেশি সহজ বিশ্বাসী। আমার কেন জানি মনে হয়, সরকার একটা সিক্রেট প্রজেক্টের মাধ্যমে আমাদের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে এ ধরনের ইচ্ছাপূরণ কূপের প্রবর্তন করলে অন্তত একটা উপকার হতো—বিভিন্ন জনহিতকর প্রতিষ্ঠানে অধিকতর অনুদান দেওয়া যেত।
যাকগে সেসব কথা। আমাদের দেশে গ্রামের এক সহজ-সরল বৃদ্ধ, যে জীবনে কখনো লিফট কী জিনিস দেখেনি, শহরে প্রথমবার বেড়াতে এসে একটি বহুতল ভবনের লিফটের সামনে দণ্ডায়মান অবস্থায় একজন বৃদ্ধাকে লিফটে ওঠার পর দরজা বন্ধ হয়ে যেতে ও খানিকক্ষণ পর উন্মুক্ত দরজা দিয়ে এক সুন্দরী যুবতীকে বেরিয়ে আসতে দেখে নাকি দুঃখ করে বলেছিল, ‘হায়! এমন জানিলে শহরে আসার সময় আমার বুড়িকেও সঙ্গে নিয়া আসিতাম।’ গিরিগুহা থেকে বেরোনোর সময় গল্পটা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় বরাবরের অভ্যাস অনুসারে আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছিল, আমি তাহলে ভালোই করেছি, আমার বুড়িকে সঙ্গে নিয়ে আসতে ভুলিনি।
বলা বাহুল্য, কথাটা আমি ব্যক্ত করেছিলাম সশব্দে ও ইংরেজিতে; আর তাতেই যত বিপত্তি! পাশে দাঁড়ানো এক শ্বেতকায় আমেরিকান-নন্দন আমাকে উদ্দেশ করে সহাস্যে বলে উঠল, ‘আপনি আপনার স্ত্রীকে শুনিয়ে বুড়ি বলেছেন। আপনাকে আজ রাতে বেডরুমের সোফাসেটে শুয়ে রাত কাটাতে হতে পারে—ইউ মে হ্যাভ টু স্লিপ ইন দ্য সোফাসেট অব ইওর বেডরুম টু-নাইট।’ ক্ষণকালের জন্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে যুক্তরাষ্ট্রে বুড়োকে বুড়ো আর বুড়িকে বুড়ি বলা যায় না। যুবকটি আমাকে সেটাই রস সহযোগে স্মরণ করিয়ে দিল।
তবে হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রে বুড়ো-বুড়িদের নিয়ে হাস্যরসের অভাব নেই। এ সম্পর্কে বাড়ান্তরে পূর্ণ একটি প্রবন্ধের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে আপাতত আমার ব্যক্তিগত ফেবারিট একটি জোক দিয়ে এই লেখাটির যবনিকা টানছি। জনৈক বৃদ্ধ আমেরিকান মৃত্যুর অব্যবহিত আগে বৃদ্ধা স্ত্রীকে অসিয়ত করলেন, ‘আমি মারা গেলে, আমি চাই যে তুমি আমার সমস্ত টাকা-কড়ি কফিনে আমার সঙ্গে দিয়ে দেবে। আমি অর্থ উপার্জন করতে অনেক কষ্ট করেছি এবং এ জন্য আমি তা পরলোকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।’ অতএব তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সময় বিধবা বুড়ি আন্ডারটেকার তথা পেশাদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদককে বলে বন্ধ কফিনের ডালা খুলিয়ে মৃতের শেষ ইচ্ছাপূরণের লক্ষ্যে একটি বৃহদাকার খাম কফিনের ভেতর প্রবেশ করাতে গেলে আন্ডারটেকার সেটা খেয়াল করে বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।’
‘আমার মাথা মোটেই বিগড়ে যায়নি,’ বৃদ্ধা প্রত্যুত্তর করলেন, ‘কিন্তু আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অতএব আমি তাঁর সকল অর্থ একত্র করে ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে একই অঙ্কের চেক কেটে স্বামীর কফিনে পুরলাম। তিনি যদি এটা ক্যাশ করতে পারেন, তাহলে খরচও করতে পারবেন।’
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷