ইমরান খানের কপাল বটে! একদিকে পার্লামেন্টে জোটের ‘সাথি ভাইয়েরা’ পাশের চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন এবং তাঁকে ‘একা’ করে দিয়ে গদি থেকে নামিয়ে দিলেন। অন্যদিকে, এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’র পাশে দাঁড়াতে রাজপথে লাখ লাখ মানুষের ঢল নামল।
রোববার দিবাগত রাতে করাচি, পেশোয়ার, মুলতান, খানেওয়াল, খাইবার, ইসলামাবাদ, লাহোর, অ্যাবোটাবাদসহ বিভিন্ন শহরে ইমরানের সমর্থনে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তায় নামার পর সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এই বিক্ষোভকারীদের সবাই যে ইমরানের দলের কর্মী-সমর্থক, তা নয়। এসব বিক্ষোভকারীর প্রায় সবাই মনে করেছেন, ইমরানকে আমেরিকার চক্রান্তে ফাঁসানো হয়েছে। আমেরিকার ইশারাতেই ইমরানের শরিকেরা ‘গাদ্দারি’ করে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এটিকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের জন্য তাঁরা হুমকি বলে মনে করছেন।
রোববার রাতের বিক্ষোভের ভিডিও নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে পোস্ট করেছেন ইমরান। ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘দুর্বৃত্তদের নেতৃত্বে আমদানি করা সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের ইতিহাসে এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত সংখ্যক মানুষ কখনোই নামেনি।’ ইমরানের এ কথায় খুব ভুল কিছু নেই। স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে এভাবে এত লোক পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো গদি হারানো প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এবং ‘আমদানি করা সরকার’ বসানোর প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষ ইমরানের ওপর বেশ খেপেও ছিল। কিন্তু ইমরানকে সরিয়ে দেওয়ার পর কেন তাঁর এত জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে? ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট যখন ইমরান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়েন, তখন তাঁর পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন ছিল না। তখন অনেকে কোনো রকম রাখঢাক না করেই বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর পছন্দ অনুযায়ী তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই জনধারণার কথা ইমরানও ভালো করে জানতেন। সে কারণে দ্রুত জনগণের মনের মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠা পপুলিজম বা জনমোহিনী নীতিই বেছে নেন।
আলী মোহাম্মাদ খান বলেছেন, ‘এটা (ইমরান খানের) সাময়িক পরাজয়। ময়দানে কারবালায় হোসাইন (রা.)–এর সাময়িক পরাজয় হয়েছিল। কিন্তু দুনিয়া তাঁকেই মনে রেখেছে। এই বার্তা ওই শ্রেণির প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যিনি স্বাধীনতাকামী, যিনি গোলামিবিরোধী।...ইনশা আল্লাহ এই চেয়ারে আমার নেতা ইমরান খান আবার আসবেন। পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফিরবেন।’
ক্রিকেটের মাঠের যে সুদর্শন ইমরান খানকে দর্শকের গ্যালারি থেকে হাজারো তরুণী উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ে দিত, সেই ইমরান রাজনীতির মাঠে নেমে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাবৎ পাকিস্তানের ‘জনগণমন অধিনায়ক’ হতে চাইলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি জাতিভিত্তিক ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকেই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিলেন। ভারত থেকে রাশিয়া; যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি থেকে যুক্তরাষ্ট্র—সবখানেই জনতুষ্টিবাদীদের জয়জয়কার দেখে ইমরান সেদিকেই ঝুঁকলেন।
ইমরান গদিতে বসার আগে বলেছিলেন, তাঁর ‘নয়া পাকিস্তান’ নৈতিকভাবে হবে মদিনা আর উন্নয়নের দিক থেকে হবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর (নরওয়ে, ডেনমার্ক) মতো। এই জনমোহিনী বক্তব্যের শেষাংশ ততটা গুরুত্ব না পেলেও প্রথমাংশকে তিনি অন্তত কথাবার্তায় সামনে আনার চেষ্টা করেছেন। ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইমরানের বৈঠকের সময় তাঁকে তসবিহ টিপতে দেখা গেছে। পাকিস্তানের ধর্মপ্রাণ মানুষ একে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইমরানের প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচনা করেছে।
২০২০ সালে জাতীয় পরিষদে এক ভাষণে ইমরান খান বলেছিলেন, ‘আমেরিকানরা যখন অ্যাবোটাবাদে ঢুকে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছিল, তাঁকে শহীদ করে দিয়েছিল, তখন আমরা পাকিস্তানিরা কীভাবে বিব্রত হয়েছিলাম, সে কথা আমি কখনোই ভুলব না।’ ওসামা বিন লাদেনকে ‘শহীদ’ আখ্যা দেওয়ায় দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে ইমরান খান ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি। কারণ তিনি জানতেন, এ ধরনের বিতর্কিত কিন্তু জনমোহিনী বক্তব্যে জনপ্রিয়তা কমে না, বরং বাড়ে।
অনাস্থা প্রস্তাব আনার পর পার্লামেন্টে ইমরানের সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আলী মোহাম্মাদ খান একটি আবেগপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর ভাষণটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে ইমরান খান মস্কোকে সমর্থন দিয়েছেন বলে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র সরিয়ে দিয়েছে—এমন দাবি নাকচ করে আলী মোহাম্মাদ খান বলেছেন, ‘রুশ ইস্যু আসলে অজুহাত। ইমরান খানের অপরাধ ছিল, তিনি বলেছিলেন, “আমরা মুসলিম ব্লক বানাব।” ইমরান খান স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। এটাই তাঁর অপরাধ ছিল। আমি স্পষ্ট বলতে চাই, রুশ স্রেফ বাহানা। তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় খতমে নবুয়তের কথা বলেছেন। ইসলামি হুকুমতের কথা বলেছেন। মদিনা সনদের কথা বলেছেন। মোড়লদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে ফেলতেন, “অ্যাবসলিউটলি নট।’”
আলী মোহাম্মাদ খান বলেছেন, ‘এটা (ইমরান খানের) সাময়িক পরাজয়। ময়দানে কারবালায় হোসাইন (রা.)–এর সাময়িক পরাজয় হয়েছিল। কিন্তু দুনিয়া তাঁকেই মনে রেখেছে। এই বার্তা ওই শ্রেণির প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যিনি স্বাধীনতাকামী, যিনি গোলামিবিরোধী।...ইনশা আল্লাহ এই চেয়ারে আমার নেতা ইমরান খান আবার আসবেন। পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফিরবেন।’
‘গাদ্দারদের’ হটিয়ে আসলেই ইমরান ফিরবেন কি না তা বলা কঠিন। কিন্তু এ বিদায় তাঁকে (তাৎক্ষণিকভাবে হলেও) জনপ্রিয়তার যে নতুন মাত্রায় নিয়েছে, আপাতত সেটিই তাঁর বিরাট প্রাপ্তি।
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক