বেশ কয়েক মাস ধরে খ্যাতনামা ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর কোনো সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রীর কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হচ্ছে না। বিনা আমন্ত্রণে ডেইলি স্টার-এর সাংবাদিক অনুষ্ঠানস্থলে গেলেও তাঁকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না। ডেইলি স্টার পত্রিকা বার্তা সংস্থা বা অন্য কোনো সূত্র থেকে প্রধানমন্ত্রীর খবর সংগ্রহ করছে। আমাদের সাংবাদিকতায় এ ধরনের সমস্যা আগে কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না। যেকোনো সংবাদপত্রের জন্য এই অবস্থা অস্বস্তিকর। আর তা যদি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে হয়, তা শুধু অস্বস্তিকরই নয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি হুমকিস্বরূপ।
অনেকে বলতে পারেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করতে পারে। হয়তো পারে। তবে যেকোনো প্রতিষ্ঠান আর সংবাদপত্র বা টিভি এক জিনিস নয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ নয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘দ্য ফোর্থ এস্টেট’ বলা হয় না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকা বিরাট। এটা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। তার পরও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর যদি এ রকম ব্যবহার করে থাকে, তা খুবই অন্যায় ব্যবহার হয়েছে বলে মানতে হবে। এ ধরনের
আচরণ সামরিক শাসন বা স্বৈরাচারী শাসনে হয়তো সম্ভব। কারণ, তখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রচর্চা স্বীকার করা হয় না। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের আচরণ অকল্পনীয়।
ডেইলি স্টার পত্রিকা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পত্রিকাটির পক্ষে নানা ভুল-ত্রুটি করাও সম্ভব। পত্রিকাটি যদি এমন কিছু করে থাকে, যা আইনানুগ নয়, তাহলে তার বিচার হতে পারে, যা অন্য দশজন অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ঘটছে। এ রকম কোনো প্রক্রিয়ায় না গিয়ে একতরফাভাবে ডেইলি স্টার-এর মতো অভিজাত ও খ্যাতনামা দৈনিকের প্রতিনিধিকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রবেশাধিকার না দেওয়া যুক্তিসংগত নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস নয়। এটা সরকারের প্রধান নির্বাহীর অফিস। অনুমতি সাপেক্ষে এখানে নীতিগতভাবে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশাধিকার রয়েছে। কোনো সংবাদপত্র প্রতিনিধির প্রবেশাধিকার অন্য অনেকের চেয়ে বেশি রয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী দলমত-নির্বিশেষে সবার প্রধানমন্ত্রী। তিনি রাগ বা অনুরাগবশত কোনো কাজ করবেন না বলে শপথ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আচরণ তা প্রমাণ করছে না।
ডেইলি স্টার পত্রিকা যদি প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে কিছু লিখে থাকে বা পত্রিকাটির কোনো মন্তব্য প্রতিবেদন বা কলাম প্রধানমন্ত্রীকে আহত করে থাকে, তাহলে তার প্রত্যুত্তরে আরও শক্ত লেখা বা প্রতিবাদ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস বিভাগ পাঠাতে পারত। সংবাদপত্রে মত, ভিন্নমত, আরও নানা মত প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। এটাই গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সৌন্দর্য।
দুই.
কয়েক দিন আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁর গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও আইনশৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতিতে এই সংবাদ সম্মেলন খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেখানে তিনি কী বলেছিলেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। এখানে সেই বিশ্লেষণ করছি না। শুধু একটা কথা লেখার জন্য এই বিষয়ের অবতারণা করেছি। তা হলো: তিনি বরাবরের মতো এবারও সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেননি। এটা খুবই অন্যায় হয়েছে।
খালেদা জিয়া একজন প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। তিনি তিনবার এ দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি তাঁর দলকে দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি কোনো নবিশ নন। কাজেই তাঁর দল বা জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচি, চলমান আন্দোলন, বহুল নিন্দিত পেট্রলবোমা-সন্ত্রাস, ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক পরীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর তো তাঁকে দিতেই হবে। সাংবাদিকেরা তো তাঁকে ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন না। দেশের রাজনীতি নিয়েই প্রশ্ন করতেন। সেই প্রশ্ন করার সুযোগ তিনি দেননি। এটা মোটেও নেতাসুলভ কাজ হয়নি। রাজনীতি করতে হলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি তাঁকে হতেই হবে। এটা খেলার নিয়ম। দুনিয়াজুড়ে রাজনীতিকদের এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। খালেদা জিয়া কোনো ব্যতিক্রম হতে পারেন না। অন্য যেকোনো পেশার ব্যক্তি সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে তাঁরা বাধ্য নন। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদের সেই সুযোগ নেই। খালেদা জিয়া অতীতেও তাঁর কয়েকটি সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের উত্তর দেননি। এই প্রবণতা নিন্দনীয়। রাজনৈতিক নেতা হলে, দলের নেতৃত্ব দিলে তাঁকে উত্তর দিতেই হবে। শুধু নিজের বক্তব্য বলার জন্য কেউ সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন না। গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বক্তব্য প্রচার করা যায়। বিএনপির প্রেস বিভাগকে এই পার্থক্যটা বুঝতে হবে। সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানালে তাঁদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে। খালেদা জিয়া যখন বড় নেতা হয়েছেন, তখন তাঁকে বড় নেতার মতোই আচরণ করতে হবে।
তিন.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন ও সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। তাঁর এই উদ্যোগ ও প্রবণতা খুবই প্রশংসনীয়। আজকাল তাঁর সংবাদ সম্মেলন কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে লাইভ প্রচার করা হয়। সেই সুবাদে এই অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ আমার বহুবার হয়েছে। একজন রিপোর্টার হিসেবে সত্তরের দশকে বহু সংবাদ সম্মেলন আমি কাভার করেছি। কিন্তু এখন দেখি পরিস্থিতি অন্য রকম। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী ঘরানার অ্যাকটিভিস্ট সাংবাদিকেরাই অংশ নেন। তাঁদের কারও কারও প্রশ্ন প্রশংসা বা স্তুতিমূলক। অনেকে প্রশ্নের বদলে প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব বর্ণনা করেন। এখন সাংবাদিকতা পেশায় নেই এমন ব্যক্তিও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য স্তুতিমূলক প্রশ্ন করেন। সবটা মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি একটা তৈলাক্ত জবজবে সাংবাদিক বৈঠক হয়ে ওঠে। যেখানে আর যা-ই থাকুক, পেশাদারি থাকে না। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বসার জায়গায় আওয়ামী লীগের সাংসদ, মন্ত্রী, নেতারাও আসন গ্রহণ করেন। অনেকে করতালিও দেন। এগুলো কোনোটাই বাঞ্ছনীয় নয়। সংবাদ সম্মেলন শুধু সাংবাদিকদের জন্য আয়োজন করতে হয়; নেতাদের জন্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বোধ হয় এগুলো জানেন না। বা জানলেও বাস্তবায়ন করতে পারেন না। সংবাদ সম্মেলন কারও স্তুতি করার জায়গাও নয়। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন করার জায়গা।
চার.
দেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল একুশে টিভি (ইটিভি) ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে দর্শকেরা দেখতে পাচ্ছেন না। রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকায় ইটিভির অনুষ্ঠান দেখা যায় না। ঢাকার বাইরে ৫০ শতাংশ জেলায় দেখা যাচ্ছে বলে ইটিভি সূত্রে জানা গেছে। ইটিভি কর্তৃপক্ষ বলেছে: কেব্ল অপারেটররা ওপরের নির্দেশে এই চ্যানেলের প্রচার বাধাগ্রস্ত করছে। উল্লেখ্য, একুশে টিভির মালিক ব্যবসায়ী আবদুস সালাম কিছুদিন আগে পর্নোগ্রাফি আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর গ্রেপ্তারের সঙ্গে একুশে টিভির সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত হওয়ার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না জানি না। তবে কোনো কেব্ল টিভি চ্যানেল কেব্ল অপারেটরদের উদ্যোগে আংশিক বন্ধ করা যায়, এ রকম অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো আইন আছে কি না, তা-ও জানি না। কেব্ল অপারেটররা ব্যবসায়ী সংস্থা। অর্থের বিনিময়ে তারা সার্ভিস দেয়। একুশে টিভি সম্পর্কে তাদের কোনো অভিযোগ আছে কি না, তা-ও তারা বলেনি। বিষয়টা পরিষ্কার করে গণমাধ্যমে কোনো পক্ষ কথা বলেনি। তথ্য মন্ত্রণালয়ও কিছু বলেনি। এভাবে কেব্ল অপারেটররা কোনো টিভি চ্যানেল বিনা অভিযোগে বন্ধ করে রাখার ক্ষমতা রাখে কি না, তথ্য মন্ত্রণালয় আমাদের জানাতে পারে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো: কেব্ল টিভি চ্যানেল মালিক সমিতির এ ব্যাপারে নীরবতা পালন। এসব সমিতি নিশ্চয় বনভোজন করার জন্য প্রতিষ্ঠা হয় না। তাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ইটিভি কর্তৃপক্ষ বলেছে: তারা এ ব্যাপারে আইনের আশ্রয় নিয়েছে।
বর্তমান সরকার গণমাধ্যম জগতে কয়েকটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের দূষিত রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে ভবিষ্যতে অন্য দল ক্ষমতায় গেলে তারা যে এসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে না, তা কি নিশ্চিত বলা যায়?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।