গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানি: কিছুই কি করার নেই

সভ্যতার শুরুতে নারীরা ঘরে নির্যাতিত হতেন। আর এখন সভ্যতার বিকাশের ফলে ঘরে নির্যাতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাইরেও নির্যাতিত হচ্ছেন! বর্তমানে গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানির ভয়াবহতা আমরা দেখতে পাই।

পৃথিবীর শুরুর দিকে কোনো গাড়ি বা গণপরিবহন আবিষ্কার হয়নি। সেসময় নারীরা যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে শুধু ঘরেই বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হতেন, সেই পরিস্থিতি আজও সমাজে বিদ্যমান। কিন্তু যখনই সভ্যতার বিকাশ ও নগরায়ণের কারণে গণপরিবহন ব্যবহারের অপরিহার্যতা তৈরি হলো এবং নারীদের ক্ষমতায়নের কারণে তাঁদের ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়ল, তখন গণপরিবহনে যৌন হয়রানির বিষয়টি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হলো।

নারীরা বাসে ওঠার সময় বাসচালকের সহকারী ও অন্যান্য পুরুষ যাত্রী দ্বারা অযাচিতভাবে শরীরে বিভিন্নভাবে স্পর্শ, অশ্রাব্য ভাষায় নারীদের লক্ষ্য করে কটূক্তি, ফাঁকা বাসে নারীদের ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। শুধু তা–ই নয়, গাড়িতে ধর্ষণ করে সেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ভুক্তভোগী নারীকে হত্যা করে নির্জন স্থানে ফেলে যাওয়ার মতো ঘটনার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।

গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের এমন ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে নির্যাতনের অনেকগুলো কারণ বেরিয়ে আসে। যার মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে—এক. নারীরা তাঁদের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের প্রতিবাদ না করে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করার প্রবণতা। দুই. নারী হেনস্তা ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত মানুষের প্রতিবাদমূলক তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নীরব ভূমিকা পালন। তিন. আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যায় এক কলেজছাত্রী তাঁর মাসহ রাজধানীর শনির আখড়া থেকে কল্যাণপুরগামী একটি বাসে উঠলে ওই বাসের কন্ডাক্টর তাঁকে শারীরিকভাবে স্পর্শের চেষ্টা করে। পরে ওই ছাত্রী তাঁর মাসহ প্রতিবাদস্বরূপ কন্ডাক্টরকে এমন আচরণ করার কারণ জানতে চেয়ে একপর্যায়ে কিল-ঘুষি মারেন। এ সময় দেখা যায় ওই বাসের অন্য সব যাত্রী কোনো প্রতিবাদ না করে নীরব ভূমিকা পালন করেন। যদিও ওই ছাত্রী আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন, কিন্তু সে সময় কন্ডাক্টরকে ধরে পুলিশে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি না থাকায় তিনি প্রতিবাদস্বরূপ এ কাজটি করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু অনেক নারী আছেন, যাঁরা এমন হয়রানির ঘটনা সমাজের মানুষের সমর্থনের অভাবে প্রতিবাদ না করে নীরবে সহ্য করে যান।

‘তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’—শীর্ষক সমীক্ষা নিয়ে গত ৫ মার্চ ২০২২ তারিখে আঁচল ফাউন্ডেশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যাতে দেখা যায়, দেশে মোট তরুণীদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৫৮ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার হন। এ ছাড়া ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। গণপরিবহন হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাস বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ তরুণী। গণপরিবহনে হয়রানির শিকার এসব নারীদের ৬৫ শতাংশই বিভিন্ন কটূক্তির মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন।
নারীরা যেখানে ঘর ও কর্মক্ষেত্রের বাইরে গণপরিবহনে নিরাপদ থাকার কথা, সেখানে দিন দিন ক্রমবর্ধমান হারে গণপরিবহনে নারী হয়রানির ঘটনা এভাবে বাড়তে থাকলে একসময় নারী নিরাপত্তা সম্পূর্ণ হুমকির মুখে পড়বে, যা একটা দেশের সুশাসনের মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের এমন বিপজ্জনক পরিসংখ্যানকে দ্রুত অনুকূল বা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য এ বিষয়ে দেশের দায়িত্বশীল সবার এগিয়ে আসা সময়ের দাবি।

শাহ জাহান
শিক্ষার্থী
ল অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া