এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বানে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে গণতন্ত্র সম্মেলন চলছে। শতাধিক দেশের সরকারপ্রধানেরা এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। তাঁদের জড়ো করতে এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রচেষ্টা চলেছে।
আমন্ত্রিত দেশগুলোর সব কটিতে যে জোরালো গণতন্ত্র আছে, তা নয়। তালিকা দেখেই বলা যায়, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে অনেকের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়া সত্ত্বেও অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, ইরাক, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও সার্বিয়ার মতো দেশগুলো আমন্ত্রণ পেয়েছে। আবার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে হোয়াইট হাউস ব্রাজিল, ভারত, ফিলিপাইন, পোল্যান্ডের মতো দেশগুলোকে আমন্ত্রণ করেছে। এ দেশগুলোতে সাম্প্রতিক কালে গণতন্ত্র পেছনের দিকেই গেছে।
আবার যেসব দেশের গণতান্ত্রিক পরিচয় নিয়ে সংশয় নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রেও কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন রয়েছে। দেশগুলোতে কি একই ধরনের অবাধ ও স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়? অথবা একই ধরনের আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অন্যের ব্যক্তি অধিকারের প্রতি একই ধরনের শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়?
একটি বিষয় নিশ্চিত যে ১০ বছর আগের তুলনায় এখন প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিধি ছোট হয়ে এসেছে। যদিও পশ্চিম ইউরোপে অতি ডান আন্দোলনের পালে সাম্প্রতিক কালে কিছুটা ভাটা পড়েছে এবং ব্রাজিল, তুরস্ক, হাঙ্গেরি, এমনকি রাশিয়ায় জনতুষ্টিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন আগের চেয়ে অজনপ্রিয় হয়েছে। এরপরও ফ্রিডম হাউসের ২০২০ সালের সূচকে ১৪৬টি দেশের মধ্যে মাত্র ৩৯টি দেশ ‘সম্পূর্ণভাবে মুক্ত’। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৩।
ফ্রিডম হাউসের তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, বড় কোনো দেশই নাগরিক স্বাধীনতা ও তরুণদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ওপরের দিকে নেই। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখনো এমন সব দেশে কেন্দ্রীভূত, যেখানে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার আগে থেকেই শক্তিশালী ছিল। আবার সেসব দেশে বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যাও বেশি।
আজকের দিনে একটি কম আলোচিত বিষয় হচ্ছে বয়স্ক জনগোষ্ঠী যেখানে বেশি, প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতি ঝোঁক সেখানেই বেশি। ফ্রিডম হাউসের তালিকায় বড় দেশগুলোর কোনোটিতেই আশ্বস্ত করার মতো স্কোর (১০০ এর মধ্যে ৮৫ নম্বর সন্তোষজনক) নেই। আবার গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। ব্যতিক্রম শুধু ছোট দেশ কোস্টারিকা ও উরুগুয়ে। দেশ দুটিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান খুব শক্তিশালী। আবার ৩০–এর ঘরে যাঁদের বয়স, তাঁদের অংশগ্রহণও বেশি।
ফ্রিডম হাউসের তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, বড় কোনো দেশই নাগরিক স্বাধীনতা ও তরুণদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ওপরের দিকে নেই। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখনো এমন সব দেশে কেন্দ্রীভূত, যেখানে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার আগে থেকেই শক্তিশালী ছিল। আবার সেসব দেশে বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যাও বেশি।
যখন বৈশ্বিক পরিবর্তনটা দ্রুত হচ্ছে এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংকট বাড়ছে, তখন জনমিতিক প্রবণতা জরুরি বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে। বয়স্ক ভোটাররা যেখানে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখেন, সেখানে বৈশ্বিক বড় ধাক্কা, অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রা সংকোচনের অভিঘাত, ভেদাভেদ সৃষ্টিকারী প্রযুক্তি, অভিবাসীদের স্রোত ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত সংকট মোকাবিলা করা কতটা সম্ভব?
জার্মানির নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল এটি। ইউরোপের মধ্যে ইতালির পরেই জার্মানিতে মধ্যবয়সী নাগরিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ। সেখানে ভোটারদের অর্ধেকের বেশি ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক। গত নির্বাচনে যোগ্য ভোটারের সংখ্যা কমেছে ১৩ লাখ। ১৯৮৭ সালে পশ্চিম জার্মানির সাধারণ নির্বাচনে ৩০–এর কম বয়সী ভোটারের সংখ্যা ছিল ২৩ শতাংশ, ৬০-এর ওপরের ভোটার ছিলেন ২৬ শতাংশ। ২০২১ সালের নির্বাচনে ৩০-এর নিচে ভোটার ছিলেন ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ, ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ভোটার ছিলেন ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ। ইতালি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মানসিক বৈশিষ্ট্য ও রাজনৈতিক পছন্দের ক্ষেত্রে বয়সের একটা গভীর প্রভাব রয়েছে। বয়স্করা কিছুটা প্রাজ্ঞ হন, কিন্তু তাঁরা বেশি মাত্রায় সতর্ক থাকেন। নতুন পরিবর্তনগুলো খুব ধীরে বুঝতে পারেন তাঁরা। ইতিহাসের বাঁক ও বদলগুলো মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের সামর্থ্য ও ইচ্ছা দুটিই কম থাকে। বিপরীতে তরুণেরা নমনীয়, ঝুঁকি গ্রহণে সাহসী এবং ধাক্কাগুলো মানিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের রয়েছে।
তরুণদের এই বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন যে সব ক্ষেত্রেই ঘটে, তা নয়। কোভিডের প্রথম এম-আরএনএ টিকা প্রথম বয়স্ক ব্যক্তিদের দেশ জার্মানিতে উদ্ভাবন করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়স্কদের দেশ জাপান রোবোটিকসের ক্ষেত্রে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। স্পষ্টতই বলা যায়, যেসব দেশে তরুণ জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে কম, তারাই এখনো উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তবে এটা স্পষ্ট যে এসব দেশ রক্ষণশীল। দীর্ঘ মেয়াদে বলিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব তাদের রয়েছে। এ কারণে খুব ছোট অভিবাসী স্রোত দেখে ইউরোপ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মুদ্রা সংকোচন হলে একই রকমের প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে দেখা যায়। সিরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানের মতো ভূরাজনৈতিক সংকটে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নগণ্য।
দৃঢ়তার ও দূরদৃষ্টির অভাব, নতুনত্বকে খোলাভাবে গ্রহণ করতে না পারায় আজকের দিনে গণতন্ত্র মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। নিশ্চিত কোনো প্রতিষেধক যেহেতু নেই, এ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে তরুণদের কণ্ঠকে সামনে নিয়ে আসা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● ফেডরিকো ফুবিনি অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিক