জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় আপিল বিভাগে আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়ে যাওয়ার পর শাহবাগ আন্দোলনে জড়িতরা বড় ধাক্কা খেয়েছেন। কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে যা যা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত ঠিক তার উল্টোটাই হলো সাঈদীর ক্ষেত্রে। ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার রায়ের পর যাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে শাহবাগে জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের মনে আবার সেই পুরোনো প্রশ্ন, সরকারের সঙ্গে নতুন করে জামায়াতের কোনো আপস হয়নি তো?
কিন্তু ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এত ওলট-পালট হয়েছে যে জনমনে যতই প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দিক, আবার একটি গণজাগরণ এখন অসম্ভব। এরই মধ্যে এই ‘মঞ্চ’ তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। সাঈদীর রায়ের পর দেখা গেল তাঁরা আবার শাহবাগে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেছেন। রায় প্রত্যাখ্যান ও সাঈদীর ফাঁসির দাবি—এসব নিয়েই জড়ো হয়েছিলেন তাঁরা। আমরা দেখলাম, একই দাবি নিয়ে জড়ো হওয়া এই পক্ষগুলোর একটি পক্ষকে পুলিশ পেটাল, পরে নিজেরা নিজেরাই মারামারি করল, চেয়ার ছোড়াছুড়ি করল। এখন কথা হচ্ছে, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে আর জামায়াত-শিবির বা হেফাজতের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। নিজেরাই তো নিজেদের দমন করার জন্য যথেষ্ট!
শাহবাগ আন্দোলন একটি অনন্য আন্দোলন হয়ে উঠেছিল এই কারণে যে একই সঙ্গে তা তখনকার সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষকেই সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোখে দেখেছিল। দুই পক্ষকেই একই সঙ্গে বিরোধিতা করার সুযোগ সব সময় জনগণ পায় না। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সর্বজনীন দাবিটি সেই সুযোগ করে দিয়েছিল। এই আন্দোলন সরকারবিরোধী ছিল, কারণ, অনেকে মনে করেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাত হয়েছে। এই আন্দোলন বিরোধী দলের বিরুদ্ধেও ছিল, কারণ, সবার মনে এই ভয় ঢুকেছিল যে একমাত্র ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো রায় হলে ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে কাদের মোল্লার মতো ব্যক্তি ছাড়া পেয়ে যাবেন। দুই পক্ষকে বিরোধিতার সুযোগ পেয়েই দলে দলে মানুষ শাহবাগে জড়ো হয়েছিল, রাস্তায় নেমে এসেছিল।
এমন একটি স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণকে তখন সরকারের পক্ষে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। সরকার তখন তাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনটিকে নিজেদের পক্ষের আন্দোলন হিসেবে দেখানোর কৌশল নেয়। এতে শাহবাগ আন্দোলন হারাতে শুরু করে তার অনন্য চরিত্র ও নষ্ট হতে থাকে এর স্বতঃস্ফূর্ততা। শাহবাগের গণজাগরণকে দখল করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হেফাজতের উত্থানের মধ্য দিয়ে এর চরম খেসারত দিয়েছে সরকার। আর জামায়াতের চিরকালের মিত্র বিভ্রান্ত বিএনপি শাহবাগ আন্দোলনের সরকারবিরোধী চরিত্রটি ধরতে না পেরে একে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবেই ধরে নেয়।
কোনো সংগঠন ছাড়া একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যে পরিণতি পায়, শাহবাগ আন্দোলনও সেই পরিণতিই পেয়েছে। তিন ভাগে ভাগ হয়ে শাহবাগ আন্দোলনের লোকজন হাতাহাতি-মারামারি করবেন, এটাও হয়তো আমাদের দেশের বাস্তবতায় স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যা-ই হোক না কেন, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির যে কাঠামো, তা এ ধরনের আন্দোলন বা গণজাগরণকে সহ্যই বা করবে কেন! ফলে আন্দোলনের মধ্যে দলাদলি, ভাঙাভাঙি ঘটিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি লাগিয়ে দেওয়া বা প্রয়োজনে লাঠিপেটা, কোনো কৌশলই এখন আর বাদ নেই।
গণজাগরণ মঞ্চের বর্তমান দশায় সরকার ও সরকারি দল থেকে শুরু করে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত সব পক্ষই নিশ্চয়ই এখন খুবই খুশি ও সন্তুষ্ট। সরকারের বাম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তো ঘোষণাই দিয়ে দিয়েছেন যে গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে মানুষের মধ্যে এখন আর কোনো ‘আবেদন’ নেই। বিবিসির সংলাপে বেশ স্বস্তি নিয়েই যেন তিনি বললেন, মঞ্চ এখন তিন ভাগে বিভক্ত। গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে এখন দেখি সব পক্ষই মিলেমিশে একাকার। এখানে তো দেখা যাচ্ছে সরকার, বিরোধী দল বা ডানে-বামে কোনো ভেদাভেদ নেই!
শাহবাগে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে গণজাগরণ হয়েছিল, তার ‘আবেদন’ কি সত্যিই ফুরিয়ে গেছে? স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনের নিশ্চয়ই অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। ট্রাইব্যুনাল বা আদালতের মাধ্যমে বিচার হবে, আর রায় হিসেবে শুধু ফাঁসি দাবি করার যৌক্তিকতা নিয়ে অবশ্যই গুরুতর প্রশ্ন তোলা যায়। আর এবার সর্বোচ্চ আদালত যখন সাঈদীর ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন, তখন তা না মেনে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের অভিযোগ তোলার বিষয়টি তো আরও গুরুতর। সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন সাঈদীকে জেলেই থাকতে হবে। এই শাস্তি গণজাগরণ মঞ্চের লোকজন বা শাহবাগ আন্দোলনে জড়িত অনেকে কেন মেনে নিতে পারছেন না তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সেই একই ভয়। শুধু দলীয় বিবেচনায় খুনের মামলার আসামিদের প্রতি রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। সামনে কোনো রাষ্ট্রপতি যে সাঈদীকে ক্ষমা করে জেলের বাইরে নিয়ে আসবেন না তার নিশ্চয়তা কী? রাশেদ খান মেনন কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে দেশে এমন কোনো সরকার আর কোনো দিনই ক্ষমতায় আসবে না?
গণজাগরণ মঞ্চের বা শাহবাগ আন্দোলনের ‘আবেদন’ তাই ফুরিয়ে যায়নি। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আরও অনেকের বিচারকাজ এখনো চলছে। রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশে এ নিয়ে সামনে কোনো আপস-সমঝোতা হবে না, সেটাই বা কে বলবে। এ দেশের রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কি কিছু আছে? শাহবাগের গণজাগরণ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার আইনটি উপহার দিয়েছে। এখন এমন একটি আইন দরকারি হয়ে পড়েছে, যাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতিও ক্ষমা করতে না পারেন। এমন একটি আইন হলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো একটি ইস্যু নিয়ে ভবিষ্যতে রাজনীতি ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করার সুযোগ কমবে। সরকার যদি নিজে উদ্যোগী হয়ে আইনটি করে, তবে সবচেয়ে ভালো। তাতে সরকারের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস অনেকটাই কমবে। আর স্বার্থ বা দলাদলির খপ্পর থেকে বের হয়ে নানা ভাগে বিভক্ত গণজাগরণ মঞ্চের উচিত, এখন এ ধরনের একটি আইনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করা। কিন্তু বোঝা যায় শাহবাগের এই বিভক্তির পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক মহলের মদদ রয়েছে। দলাদলি সহজে দূর হবে এমন আশা করা আসলে দুরাশাই।
শাহবাগ আন্দোলনের বর্তমান দশা যা-ই হোক, একটি ধ্রুপদি গণ-আন্দোলনের সব বৈশিষ্ট্য নিয়েই তা হাজির হয়েছিল। দলের নেতৃত্বের বাইরে, আধিপত্যকামী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব ছাড়াই এর সূচনা হয়েছিল। ন্যায়বিচারের দাবি ও দীর্ঘদিনের জমে থাকা অসন্তোষের প্রকাশ ঘটাতে এই সুযোগে রাস্তায় নেমে এসেছিল জনগণ। এ ধরনের আন্দোলন কখনো সংগঠিতভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বা দিনের পর দিন চলতে পারে না। সেই ‘পারি কমিউন’ থেকে শুরু করে ইউরোপের নানা বর্ণের আন্দোলন (চেক প্রজাতন্ত্রের ভেলভেট বিপ্লব, জর্জিয়ার গোলাপি বিপ্লব, ইউক্রেনের কমলা বিপ্লব) থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের ‘আরব বসন্ত’ বা অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন, সব ক্ষেত্রেই এমনটি হয়েছে। শাহবাগের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে বা হচ্ছে।
শাহবাগের ‘আবেদন’ ফুরিয়ে গেছে বলে কেউ কেউ তৃপ্তি পেতে পারেন। কিন্তু তাঁরা নিশ্চয় এটা ভালোই জানেন যে এ ধরনের আন্দোলনে মূল শক্তি সাধারণ মানুষ। যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ শাহবাগে জড়ো হয়েছিল, বিশেষ করে তরুণেরা, তা কি তাদের মধ্য থেকে এরই মধ্যে চলে গেছে? শাহবাগের আবেদন তো এত তাড়াতাড়ি ফুরানোর নয়।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]