খেলায় রাজনীতি, রাজনীতির খেলা

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

টেলিভিশনের স্ক্রলে ২৬ সেপ্টেম্বর বিকেলের দিকে হঠাৎ খবরটা চোখে পড়ে। জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল নির্ধারিত দিনে বাংলাদেশে আসছে না। ২৮ সেপ্টেম্বর দলটির বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। সেই মনভাঙা প্রশ্নটি এবার সামনে চলে আসে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের গায়েও কি জঙ্গি তকমা লেগে গেল?
অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের মধ্যে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ শুরু হওয়ার কথা ছিল ৩ অক্টোবর ফতুল্লায়। আর ৯ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রামে শুরু হওয়ার কথা প্রথম টেস্ট। বাংলাদেশের ক্রিকেট যে সময়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে, সে সময়ে এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা একটা বড় ধাক্কা বৈকি। আর এই ধাক্কা তো কেবল ক্রিকেটের ওপর নয়, এর শেষ গন্তব্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের হৃদয়ে।
অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শন ক্যারল দ্রুত উড়ে এলেন ঢাকায়। ২৭ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলীয় হাইকমিশন কার্যালয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করলেন। পরদিন গেলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের ভিভিআইপি নিরাপত্তাদানের আশ্বাস দেওয়া হলো। ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনও নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করল। কিন্তু তিনি বললেন, সিদ্ধান্ত নেবে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড।
নিজ দেশের খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার জন্য অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগ স্বাভাবিক। বিশেষ করে জঙ্গি হামলার আশঙ্কাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে ক্রিকেট ম্যাচে গাড়িবোমা হামলা হয়েছে। সুতরাং শন ক্যারলের ব্যস্ততা ও উদ্বেগকে অস্বাভাবিক বলা যায় না। কিন্তু তাঁর একক সিদ্ধান্তে হঠাৎ সফর স্থগিত করে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি বাংলাদেশকে বিব্রত করার জন্য যথেষ্ট নয়?
অস্ট্রেলিয়া যখন খেলোয়াড়দের ওপর জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করছে, তখন এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী? ২৭ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন, অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের ওপর জঙ্গি হামলার আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও কথা বললেন একই সুরে। আর গোয়েন্দা দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম এ ধরনের আশঙ্কা দিলেন উড়িয়ে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, শন ক্যারলের কাছে কী এমন তথ্য ছিল, যা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে ছিল না?
বাংলাদেশের গোয়েন্দারা অস্ট্রেলিয়ার গোয়েন্দাদের চেয়ে বেশি দক্ষ, এমন দাবি কোনো বোকাও করবে না। অন্তত জঙ্গি হামলার বিষয়ে কোনো বড় রাষ্ট্রই এককভাবে তথ্যের ব্যাপারে কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার ধসিয়ে দেওয়ার ঘটনা এর বড় প্রমাণ। এখন পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তের কোনো দেশে বসে যখন পশ্চিম প্রান্তের দেশে হামলার পরিকল্পনা করা হয়, তখন বাংলাদেশে হামলার ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার হাতে কী ‘তথ্য’ আছে, সেটি জানা দরকার। বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশই বর্তমান সময়ে জঙ্গি হামলার ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ অবস্থায় পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদানই এই ঝুঁকি কমিয়ে আনার বড় উপায়। এ উপায়কে কাজেও লাগানো হচ্ছে। অনেক দেশের মধ্যে এ বিষয়ে পারস্পরিক চুক্তি আছে।
অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের বন্ধু দেশ। এ দুই দেশের মধ্যে বিশেষত ক্রিকেট-সম্পর্ক অনেক দিনের। বাংলাদেশ কখনোই অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাইবে না। এতে বাংলাদেশের ক্ষতিটাই বরং হবে বেশি। এ অবস্থায় যার কাছেই তথ্য থাক, উভয় দেশ একত্রে তা যাচাই করে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে কিন্তু তা ঘটেনি। বাংলাদেশের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, অস্ট্রেলিয়া এককভাবে ক্রিকেট সফর স্থগিত করেছে। আর এটা করার পর শন ক্যারল বাংলাদেশে তাঁদের খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে এলেন। এতে বাংলাদেশকে কতটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়।
পাকিস্তানের অবস্থার কথা মনে পড়ছে। সেখানে অন্য দেশ ক্রিকেট খেলতে যায় না। নিরাপত্তাব্যবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার পর সফর বাতিল করে। গত দেড় দশক হলো চলছে এ অবস্থা। এর মধ্যে ব্যতিক্রম অবশ্য বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। তারা সেখানে খেলতে গেছে সাহসের সঙ্গে। পাকিস্তানে ক্রিকেট সফর বাতিলের ব্যাপারটি স্বাভাবিক। সেখানে কী ঘটছে, তা বিশ্ববাসী জানে। জঙ্গি হামলা সেখানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেনাবাহিনীও জঙ্গিদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তো অস্ট্রেলিয়ার কাছে বাংলাদেশ কি আজ পাকিস্তান হয়ে গেল? একি কেবল নিরাপত্তা ঝুঁকি, নাকি অন্য কিছু?
বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় চীন বর্তমানে শক্ত অবস্থানে, পাশাপাশি এই ব্যবস্থায় ভারতের নবযোধ হিসেবে উত্থান এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানও এই নতুন মাত্রার আওতাধীন। কাজেই শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক টানাপোড়েন ও জটিল দর-কষাকষির অমসৃণ পথে হোঁচট খেতে খেতেই বাংলাদেশকে চলতে হবে।
শক্তিধর দেশগুলোর কাছে প্রভাব বিস্তারকারী কৌশল হিসেবে ‘তকমা-তত্ত্ব’ নতুন কোনো ঘটনা নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে গত শতকের নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ‘কমিউনিস্ট তকমা’ বেশ কার্যকর ছিল। এই তকমা-মাহাত্ম্যে আফগানিস্তানের অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছে, তা আজ সবারই জানা। আর কমিউনিস্ট রুখতে গিয়ে তালেবানি শক্তিকে উসকে দেওয়ার ফলে আফগানিস্তানের পাশাপাশি পাকিস্তানের মেরুদণ্ডও গেছে ভেঙে। কমিউনিস্ট তকমার পর এল ‘পারমাণবিক শক্তি’ তকমা। ইরাক এই তকমার সব থেকে বড় বলি। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো সম্প্রতি একটি চুক্তি করলেও শেষ পর্যন্ত ওই দেশটির কপালে কী আছে, তা নিশ্চিত করে বলা শক্ত।
বর্তমানে সবচেয়ে ‘জনপ্রিয়’ তকমা হলো ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘জঙ্গিবাদ’ তকমা। একবার এই তকমা এঁটে দিতে পারলে প্রতিপক্ষের ওপর দাদাগিরি করা অনেক সহজ হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নজিরবিহীন তছনছ অবস্থা থেকে এই তকমার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আঁচ করা সম্ভব।
জঙ্গি তকমা-তত্ত্বের সুবিধার দিকটি হলো, যে দেশের ওপর এটা প্রয়োগ করা হবে, সে দেশে (যেসব দেশে ধর্মকে জঙ্গিবাদের বাইরের আবরণ হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব) এর ক্ষেত্রটি প্রায় প্রস্তুতই থাকে। কেবল খানিকটা উসকে দিলেই হলো। সাধারণভাবে স্থানীয় জনবিচ্ছিন্ন, পরাজিত ও হতাশ-হীনম্মন্য শক্তিও এই উসকানির জন্য ওত পেতে থাকে। আর বিন লাদেন বা জাওয়াহিরির মতো কারও ডাক পেলেই শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। বিন লাদেনের মতো রাবণদের কে বা কারা তৈরি করে, তাদের বিপুল অর্থের উৎস কী, এসব রহস্য তো আজ অনেকটাই উন্মোচিত।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অর্থাৎ অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যেও এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দেশ এখন কারও মুখাপেক্ষী নয়। বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়াই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, জিএসপি-সুবিধার জন্য বাংলাদেশের আর তেমন করণীয় নেই। সুতরাং সাহসী এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হলে এবং বড় শক্তির তোয়াক্কা না করে আঞ্চলিক শক্তির হাত ধরে চলতে গেলে বাংলাদেশকে জঙ্গি তকমার হ্যাপা সামলাতেই হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এসব সামাল দেওয়ার মতো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি বাংলাদেশের আছে কি না।
অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গি হামলার আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দা মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম ২৭ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশে একমাত্র ত্রিশালের পুলিশভ্যান থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ছাড়া গত ছয় বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। এই বক্তব্যের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়া লেখকদের (ব্লগার) হত্যার ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হলো। যখন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতো চিহ্নিত জঙ্গিগোষ্ঠী বুক চিতিয়ে এসব হত্যার দায় স্বীকার করছে, তখন রাষ্ট্র কেন এগুলোকে জঙ্গি ঘটনার তালিকা থেকে দূরে রাখতে চায়, তা বোধগম্য নয়।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।