খেলাপি রোগের কারণ ও চিকিৎসা
আমাদের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে যত আলোচনা, উত্কণ্ঠা ও হতাশা প্রকাশ করা হয়, তার কিছুটা যদি এই উপসর্গের কারণ ও সমাধান নির্ণয়ে সচেষ্ট হওয়া যেত, তাহলে হয়তো এই সংকট থেকে পরিত্রাণের একটা পথ এত দিনে বের করা যেত। যেকোনো রোগের চিকিৎসার জন্য দরকার লক্ষণ বিচার করা, এই খেলাপি রোগের চিকিৎসার জন্যও তা করা অবশ্য প্রয়োজনীয়। লক্ষণ বিচারের জন্য রোগের উৎস ও কারণগুলো নিরূপণ করা দরকার, যাতে সেসবের উপযুক্ত প্রতিকার করা যায়।
খেলাপি ঋণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয় অযথার্থ ঋণঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং ঋণদানের পর বিভিন্ন তৎপরতার মধ্য দিয়ে। ঋণখেলাপির বহু কারণের মধ্যে মূল কারণগুলো মোটাদাগে সাধারণত এ রকম হয়: (১) ব্যাংক থেকে সহজেই পাওয়া যায় বলে বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও ঋণ নেওয়ার প্রবণতা, (২) অতি আশাবাদী ভুল ব্যবসায়িক পূর্বাভাসের কারণে বিনিয়োগের ঝুঁকিগুলো অনুধাবনের ব্যর্থতা, (৩) নিজস্ব পুঁজির অপ্রতুলতার কারণে ব্যাংকঋণের ওপর অতিনির্ভরতা, (৪) ক্ষমতাতিরিক্ত ব্যবসার চেষ্টা, (৫) ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন করে অন্যায্য ঋণসুবিধা গ্রহণ, (৬) চলতি মূলধন ঋণকে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী সম্পদে রূপান্তরিত করা, আমাদের দেশের ঋণখেলাপিদের অনেকেই ঋণের টাকা সরিয়ে ভূসম্পত্তি কিনে ঠিক এই কাজটিই করেছেন, (৭) এক ব্যবসার জন্য গৃহীত ঋণের অর্থ ব্যাংকের অগোচরে ভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা, (৮) যোগ্য ব্যবসায়িক উত্তরসূরি তৈরি না করার ফলে পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়িক লোকসান, (৯) ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যকার কোন্দল কিংবা মতানৈক্য, (১০) ঋণ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়ে গা–ঢাকা দেওয়া এবং (১১) গ্রাহকের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত নানাবিধ কারণে ব্যবসা নষ্ট বা লোকসান হওয়া।
ঋণ খেলাপের জন্য ব্যাংকের দায়দায়িত্বও উপেক্ষা করার উপায় নেই। সেগুলো এ রকম হতে পারে: (১) ঋণগ্রহীতা নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্ত, (২) গ্রহীতার দেওয়া বিবিধ তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই না করে ঋণ অনুমোদন করা, (৩) গ্রাহকের প্রয়োজন নিরূপণ না করে শুধু প্রতিষ্ঠানের সুনামের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনাতিরিক্ত ঋণ দেওয়া, (৪) জামানত হিসেবে দেওয়া সম্পত্তির দলিলপত্রের সত্যতা ও মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে বন্ধক গ্রহণ করা, (৫) বিতরণকৃত ঋণের অর্থের সঠিক ব্যবহারের ওপর নজরদারি না রাখা এবং সর্বোপরি (৬) ঋণদানে অযোগ্য গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংককর্মীর অশুভ আঁতাত।
এসবের বাইরে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে মূল কারণগুলো প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ রকম। আমাদের বর্তমান ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে কয়েকটি প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মুনাফা বৃদ্ধি করার তীব্র প্রতিযোগিতায় ব্যাংকগুলো পূর্বাপর বিবেচনা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত প্রয়োজন নিরূপণ না করে কেবল ঋণ বৃদ্ধির জন্য যে হারে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ঋণ বিতরণ করে আসছে, সেটিই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অনেক কারণের অন্যতম। অবাধ ঋণ লাভের সুযোগ নিয়ে বহু প্রতিষ্ঠান ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে সরিয়ে ফেলে হারিয়ে ফেলেছে পরিশোধের ক্ষমতা। ২০০৯ সালে মোট ব্যাংকঋণ ছিল ২ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা ১০ বছরের মাথায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ২৮২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, ১০ বছরের মাথায় এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকায়, অর্থাৎ ৩২৭ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণ ২২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, পরের বছরেই তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৪৩ হাজার কোটিতে উন্নীত হয়। ২০১২ সালে ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়ার কারণে ২০১৩ সালে খেলাপি ঋণ ৪০ হাজার কোটিতে নেমে এসেছিল, তার পরের বছর থেকে বাড়তে বাড়তে ২০১৮ সালের শেষে যে হিসাব দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণের অঙ্ক যোগ করলে এই পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
ঋণখেলাপির এসব কারণ সব সময়ে প্রযোজ্য। তবে আমাদের খেলাপি ঋণের গতি–প্রকৃতি দেখে একটি উপাদানের সঙ্গে এর আংশিক সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়। ২০০৮ সালের শেষ ভাগে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার ফলে পণ্যবাজারে শুরু হয় মূল্যধস। সেসব পণ্যের মধ্যে ছিল খাদ্যশস্য, জ্বালানি ও ভোজ্যতেল, ধাতু, রাসায়নিক দ্রব্য, ইস্পাত ইত্যাদি। গমের মতো শস্যের বাজারমূল্য পড়ে যায় ৪০ শতাংশ, জ্বালানি তেল ৪৪ শতাংশ, আর ধাতুর বাজার প্রায় ৩৩ শতাংশ। আমদানিনির্ভর বহু দেশ এই ধসের শিকার হয়, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ফলে গমজাতীয় পণ্য, জাহাজভাঙা শিল্পের কাঁচামাল এবং অন্যান্য পণ্যের বৃহৎ আমদানিকারকদের অনেকেই এই ধসের অভিঘাত সামলে উঠতে পারেনি। তারপর ঘটে ২০১০ সালের শেয়ারবাজারের ধস। এই বছরের প্রথম দিকে যে উন্মাতাল গতিতে দেশের পুঁজিবাজারের উল্লম্ফন ঘটে, তার লোভের হাতছানি এড়াতে পারেননি সাময়িক মৌসুমি বিনিয়োগকারীরা। পূর্বাপর বিবেচনা না করে শেয়ারবাজারে লগ্নি করে বসে বড়ো, ছোট ও মাঝারি বহু ঋণগ্রহীতা। বছরের শেষে মূল্যসূচক যখন ভারী পাথরখণ্ডের মতো পড়তে থাকে, তার তলায় চাপা পড়ে সর্বস্বান্ত হয় অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারী, সমূহ ক্ষতির কবলে পড়ে বৃহৎ বিনিয়োগকারীরাও। তাদের সঙ্গে পাথরচাপা পড়ে মূল খাত থেকে সরিয়ে ফেলা ব্যাংকের বিশাল অঙ্কের ঋণের অর্থ।
এই দুটি প্রধান কারণে ২০১২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের তিন বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গিয়েছিল। পরের বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা কমে যাওয়ার কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই দুটি আংশিক কারণ, একমাত্র নয়।
ব্যাংকঋণের সহজলভ্যতা ও অপব্যবহার রোধ করে সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ভারতে ১৯৭৪ সালে গঠিত হয়েছিল একটা স্টাডি গ্রুপ, যা ‘টেন্ডন কমিটি’ নামে পরিচিত। সে কমিটি পরের বছর যে রিপোর্ট পেশ করে, সেটি বাস্তবায়ন করে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রিপোর্টের সুপারিশমালার মূল লক্ষ্য ছিল গতানুগতিক জামানতনির্ভর ঋণদান পদ্ধতির পরিবর্তে প্রয়োজনভিত্তিক ঋণ অনুমোদনের সংস্কৃতি চালু করা। কমিটির নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয় যে ব্যাংকঋণের সর্বোৎকৃষ্ট নিরাপত্তা হচ্ছে একটি লাভজনক ব্যবসা, কোনোক্রমেই ভূসম্পদের জামানত নয়। কমিটির প্রধান সুপারিশমালার মধ্যে ছিল (১) ঋণগ্রহীতার ব্যবসায়িক পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে যৌক্তিকভাবে প্রয়োজনীয় ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করা, (২) ব্যাংকঋণকে গ্রহীতার পুঁজির পরিপূরক বিবেচনা করা, কোনোভাবেই তার বিকল্প হিসেবে নয়, অর্থাৎ ব্যাংক ঋণগ্রহীতার প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের সম্পূর্ণ অংশ বহন করবে না, (৩) গৃহীত ঋণের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গ্রহীতার ওপর নিবিড় নজরদারি রাখা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তারোপ করা, (৪) কাঁচামাল, উত্পাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কাঁচামাল ও তৈরি পণ্যের মজুত এবং পাওনার পরিমাণ ও সম্ভাব্য আদায়ের সময় বিবেচনা করে চলতি মূলধনের প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করা।
প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের পরিমাণ নিরূপণের জন্য টেন্ডন কমিটি দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করার সুপারিশ করেছিল। কোনো প্রতিষ্ঠানের মোট চলতি সম্পদ ও (ব্যাংকঋণ বাদে) চলতি দায়ের মধ্যকার যে পার্থক্য, সেটিই চলতি মূলধন হিসেবে ধরতে হবে, এটিকেই বলা হবে সর্বোচ্চ অনুমোদনযোগ্য ব্যাংকঋণ (ম্যাক্সিমাম পারমিসিবল ব্যাংক ফাইন্যান্স বা এমপিবিএফ)। যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ রুপির কম, সেগুলোকে ব্যাংক জোগান দেবে প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে ১০ লাখ রুপির বেশি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য পদ্ধতিতে গ্রহীতা তার মোট চলতি সম্পদের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ নিজস্ব পুঁজি থেকে বহন করবে, বাকি অংশ এমপিবিএফ হিসাব করে জোগান দেবে ব্যাংক। অর্থাৎ ব্যাংকঋণসহ চলতি দায় যাতে কোনোক্রমেই চলতি সম্পদের ৭৫ শতাংশের বেশি না হয়।
চলতি মূলধন হিসাবের এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে ভারতের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল। তাদের বক্তব্য ছিল যে এই পদ্ধতি মান্ধাতা আমলের এবং এটির মাধ্যমে যে চলতি মূলধন নিরূপণ করা হয়, তা অপ্রতুল। অবশেষে ১৯৯৬ সালে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের পরামর্শে এবং ইন্ডিয়ান ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে গঠিত কানন কমিটি এমপিবিএফ পদ্ধতি বিলোপের সুপারিশ করে। কানন কমিটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এক থেকে দেড় বছর মেয়াদি ডিবেঞ্চার ছেড়ে চলতি মূলধন সংগ্রহের সুপারিশও করেছিল। এই সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ২০ বছর ধরে চালু পদ্ধতিটি বিলোপের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৭ সালে, যা সম্পূর্ণভাবে তুলে নেওয়া হয় ২০১৩ সালের মধ্যে।
ভারতে চলতি মূলধন হিসাবায়নের এই পদ্ধতি প্রায় তিন দশক ধরে চালু থাকার পর ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় একটা সুশাসনের সংস্কৃতি চালু হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে এটির প্রয়োগ ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের দেশে এই পদ্ধতিটি হুবহু না হলেও তার বিকল্প কিংবা সম্পূরক কোনো ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যাতে নামী প্রতিষ্ঠানের সুনাম দেখে অপ্রয়োজনীয় এবং পুঁজিবিহীন উদ্যোক্তাকে ঋণদানের প্রবণতা বন্ধ হয়। প্রথমে উল্লিখিত কারণগুলো নিরাময়ের পাশাপাশি ঋণের প্রয়োজনীয়তা হিসাবায়ন পদ্ধতির সংস্কারের মাধ্যমে ঋণের অপব্যবহার রোধ করে খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়া খর্ব করা যায়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার
[email protected]