খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যের জয় হয়েছে
অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার শেষ ভরসা যে উচ্চ আদালত, আবারও তা প্রমাণিত হলো। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ফায়েক উজ্জামানের রোষের শিকার হয়েছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই তিন শিক্ষক ও দুই শিক্ষার্থী। প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে দুই শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ বাতিল করলেও তিন শিক্ষককে শাস্তি দিয়েই তিনি ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন। আদালত সেই শাস্তি স্থগিত করে চার সপ্তাহের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর আদেশ দিয়েছেন।
শাস্তিপ্রাপ্ত তিন শিক্ষক হলেন বাংলা ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল ফজল, প্রভাষক শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরী। তাঁদের মধ্যে আবুল ফজলকে বরখাস্ত এবং অপর দুজনকে অপসারণ করা হয়। অভিযোগ আনা হয়েছিল চার শিক্ষকের বিরুদ্ধে। একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকায় শাস্তি থেকে রেহাই পেয়েছেন। সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করার অর্থ হলো তিনি অন্য কোনো সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন না। এর অর্থ তাঁর পেশাগত জীবন ধ্বংস করা। একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাঁরই তিন সহকর্মীর প্রতি কীভাবে এ নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারলেন, সেটাই প্রশ্ন।
এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবৈধ আর্থিক সুবিধা লাভ কিংবা নৈতিক স্খলনের কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগটি হলো, তাঁরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘উসকানি’ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে চারজন শিক্ষকের ‘সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে’ মর্মে ব্যাখ্যা দাবি করা হয়। একটি ঘটনার কোনোরূপ তদন্ত ছাড়াই সংশ্লিষ্টতা ‘প্রতীয়মান হয়েছে’ বলার উদ্দেশ্য কী? কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত শিক্ষকদের কাছে প্রথম ব্যাখ্যা চায় ১৩ অক্টোবর। এরপর দুই দফা কৈফিয়ত তলব করে ৯ নভেম্বর ও ১৭ ডিসেম্বর। তাঁরা যথারীতি জবাব দিয়েছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে সিন্ডিকেটের বৈঠক ডেকে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। অভিযুক্ত শিক্ষকদের বক্তব্য, তাঁরা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়ে কোনো অন্যায় করেননি। অথচ উপাচার্যের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন।
গত ২৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ২১২তম সভায় ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তটির বিরুদ্ধে তিন শিক্ষক উচ্চ আদালতে রুল আবেদন করলে গত মঙ্গলবার আদালত উল্লিখিত রায় দেন।
শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিলেন পাঁচ দফা দাবিতে, যথা: শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ, বেতন-ফি কমানো, অবকাঠামো নির্মাণে দুর্নীতির প্রতিকার, শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা–পরিপন্থী অধ্যাদেশ সংস্কার। এর কোনোটি অযৌক্তিক নয়। দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীরা গত বছরের ১ ও ২ জানুয়ারি হাদী চত্বরে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। অবরোধের দ্বিতীয় দিন দুজন শিক্ষক সেই চত্বর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে চাইলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের পাশের মাঠ দিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু শিক্ষকদ্বয় তাঁদের কথায় কর্ণপাত না করে অবরোধস্থল দিয়েই গাড়ি চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। শিক্ষকের সঙ্গে কোনো শিক্ষার্থীর অসৌজন্যমূলক আচরণ কাম্য নয়। কিন্তু সেদিনের ঘটনা ঘটেছে উপাচার্যের আস্থাভাজন দুই শিক্ষকের একগুঁয়েমির কারণেই।
এ ঘটনার আট মাস পর কর্তৃপক্ষ দুই শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগের বাংলা ডিসিপ্লিনের মোহাম্মদ মোবারক হোসেন (১৮তম ব্যাচ) এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের ইমামুল ইসলামকে (১৭তম ব্যাচ) কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। এর জবাবে তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন, যেখানে অবরোধ কর্মসূচিতে কয়েক শ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন, সেখানে দুজনকে কেন নোটিশ দেওয়া হলো? কর্তৃপক্ষ এ প্রশ্নকে ঔদ্ধত্য হিসেবে নেয় এবং মোবারক হোসেনকে এক বছরের জন্য ও ইমামুলকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করে।
এ অন্যায় সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে দুই শিক্ষার্থী প্রথমে ক্যাম্পাসে অবস্থান ধর্মঘট, পরে আমরণ অনশন শুরু করেন। অনশনের আগে এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার অনশনের খবর শুনে পরিবারের সদস্যদের কিছু হলে তার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই নিতে হবে।’ একপর্যায়ে দুই শিক্ষার্থীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সহপাঠীরা তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাঁদের দেখতে পর্যন্ত যাননি। অনশনরত দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন খুলনার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সংস্কৃতিসেবী ও সহপাঠীরা। মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেন তাঁরা। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই সমিতির মধ্যস্থতায় কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আশ্বাস দিলে আট দিনের মাথায় দুই শিক্ষার্থী অনশন ভাঙেন। উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয় ২৮ জানুয়ারি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করেছিলেন, শেষ মুহূর্তে উপাচার্য হয়তো তিন শিক্ষকের দণ্ডাদেশও প্রত্যাহার করে নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
নিরুপায় হয়ে তিন শিক্ষক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। গত মঙ্গলবার আদালত দলগত চাকরিচ্যুতির আদেশের বিরুদ্ধে রুল নিশি এবং তিন শিক্ষককে শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে স্থিতাদেশ জারি করেন। আদালতের আদেশের ফলে ওই শিক্ষকদের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে কোনো আইনি বাধা নেই। তিন শিক্ষকের পক্ষে মামলা লড়েছিলেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বার অ্যাট ল। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের মামলাও তিনি লড়েছিলেন। ১০ মাস পর শফিকুল জামিনে মুক্তি পান।
গত বুধবার ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষকবৃন্দ’–এর ব্যানারে শিক্ষকেরা সংবাদ সম্মেলন করে আদালতের রায় মেনে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ‘আদালতের রায় প্রমাণ করে যে ওই শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা ছিল অযৌক্তিক ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ। আমরা আশা করব, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, তারা আদালতের রায়কে যথাযথ সম্মান জানাবে এবং সাধারণ জনগণের টাকা খরচ করে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে ওই তিন শিক্ষকের হয়রানি দীর্ঘায়িত করবে না।’ অনতিবিলম্বে সিন্ডিকেট সভা ডেকে শিক্ষকদের বরখাস্ত ও অপসারণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান তাঁরা। শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও সহ-উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও অনুরূপ দাবি জানায়।
ফায়েক উজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকতে এর আগেও এক শিক্ষককে তুচ্ছ কারণে বরখাস্ত ও পদাবনত করা হয়েছিল। আদালত সেই সিদ্ধান্তকেও বেআইনি বলে রায় দিয়েছিলেন।
শিক্ষকেরা আশা করেন, শুধু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ভবিষ্যতে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই যেন কোনো শিক্ষককে এ রকম ন্যক্কারজনক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে আদালতে যেতে না হয়। একই দিন ক্যাম্পাসে প্রেস ব্রিফিং করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আদালতের রায় মেনে শিক্ষকদের পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত তিন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কোনো অন্যায় করেননি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও আদালতের রায়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যের জয় হয়েছে। তিন শিক্ষক ও দুই শিক্ষার্থীর ওপর কর্তৃপক্ষ যে অন্যায় করেছিল, তার প্রতিকার তাঁরা পেয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তথা সাবেক উপাচার্যের একগুঁয়েমি আচরণের কারণে তিন শিক্ষকের ইতিমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে, তা সহজে পূরণীয় নয়। সামাজিকভাবে তাঁদের হেয় করার চেষ্টা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পথ উন্মুক্ত করবে, এটাই প্রত্যাশিত। ভবিষ্যতে যিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে আসবেন, আশা করি তিনিও বিষয়টি মনে রাখবেন।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি