ভোটারের মর্যাদা হারানোর পর ভোটার তালিকায় নাম থাকা না-থাকায় কিছু যায়–আসে না—এমন কথা যে কেউ বলতেই পারেন। তবে কথাটি ‘প্রতিধ্বনিহীন’। এর কোনো আসর পড়বে না কোথাও। অবশ্য ভোটার আইডি বা ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’—এই পোশাকি নামওয়ালা বস্তুটি অনেক কাজের, এটি বেহদ বাস্তবতা। ব্যাংক হিসাব খুলতে লাগে, মুঠোফোনের সিম কিনতে লাগে, পাসপোর্ট করাতে লাগে ইত্যাদি। প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় এমন বহু কাজকর্মে লাগায় ভোটার আইডির গুরুত্ব অনেক। তাই যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে এটি সংরক্ষণ করতে হয় আপনাকে। এমনটা সচরাচরই দেখা যায়, অনেকেই মূল আইডি পকেটে নিয়ে ঘোরেন। ফটোকপি রাখেন প্রায় সবাই। না জানি, কখন কোনো কাজে কর্তৃপক্ষ চেয়ে বসে।
আপনি যে এই দেশের নাগরিক, তার ‘প্রমাণপত্র’ হয়ে ওঠা ভোটার আইডি দেখালে অবশ্য আপনি কোথাও নির্বিঘ্ন নাগরিক সেবা-পরিষেবা পাবেন, তা কিন্তু নয়। যেখানে ঘুষ দরকার, দিতে হবে। তদবির লাগলে করবেন, মামা-চাচা থাকলে ধরবেন। পকেটও ফাঁকা, মাথার ওপর আশীর্বাদের হাতও নেই, তাহলে দরকারি কাজটি আপনার হবে না কিংবা সেবাটি আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়!
কোনো অফিস-কাছারিতে এমনি এমনি কোনো কাজ হয় না; কাজ ‘করিয়ে নিতে’ হয়। একে ‘হ্যাপা’ বলেন, ঝক্কি বা হয়রানি বলেন, এর বাইরে যাওয়ার উপায়ও নেই আপনার। অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করা, অম্লান বদনে অন্যায় হজম করা নাগরিকত্বের শর্ত নয় বটে, তবে এটি মোটাদাগে আপনার জীবনের ‘অলঙ্ঘনীয় অংশ’। তাই সত্যি বলতে, আপনার কোনো ‘উপায়’ নেই। দেশে থাকতে হলে এসব মানতে হবে।
মানতে হবে রক্তপাত, সংঘাত, কারচুপি সত্ত্বেও নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ হয়েছে। কেননা, কর্তৃপক্ষ তা-ই বলছে। ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে দিন ছয়জনের প্রাণ ঝরল। আর আগে প্রচার-প্রচারণাকে কেন্দ্র করে গেছে প্রাণ গেছে ২১ জনের। প্রথম ধাপের নির্বাচন হয়েছে পাঁচজনের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে। আগামী ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে রক্তের দাগ লাগবে না, এ কথার নিশ্চয়তা কেবল পাগলের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব!
দেশে ভোটের যা রূপ, তা সর্বার্থেই ‘যুদ্ধ’। যুদ্ধে হতাহত এড়ানো যায় না, এমনকি স্নায়ুযুদ্ধেও এখন রক্তপাত অনিবার্য। সাধারণ জ্ঞান এস্তেমালে এটুকু বুঝতে পারলে দেখবেন, চোখ খোলা রেখেও সেভাবে কিছুই দৃশ্যমান নয় আপনার সামনে। কানে মাফলার জড়াননি, তবু আপনার কর্ণকুহরের পর্দা প্রায় আলোড়নহীন। যেটুকু দেখাশোনা, তা অনেকটা গর্ত দেখে পা ফেলা এবং হর্ন শুনে সরে দাঁড়ানোর সঙ্গে তুলনীয়। প্রাণের ধুকপুক যতক্ষণ আছে, জীবনটা ততক্ষণ টেনে নেওয়া আরকি।
আপনার মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ ডলার। এ কথা শুনে একটু ধন্দে পড়তে পারেন বৈকি। ভোট না দিতে পারলেও আপনি যেমন ‘ভোটার’, জীবন চালাতে হিমশিম খাওয়া আপনার আয়রোজগারের হিসাব তেমনি ফুলেফেঁপে একাকার!
তাই সব দিক দিয়ে ‘উপায়হীন’ আপনার সামনে বিদ্যমান বাস্তবতার কাটাছেঁড়ার করার কোনো মানে হয় না। মেনে নেওয়াই যখন ‘শেষ কথা’, তখন যেকোনো কথাই বাহুল্য। তাই বাহুল্য এ কথা বলা যে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপ বলছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। এর মানে গত ছয় মাসে গরিবের কাতারে দাঁড়িয়েছে ৭৯ লাখ মানুষ।
অর্থাৎ আপনি যদিও–বা তথাকথিত ‘দারিদ্র্যরেখা’র ওপরে ছিলেন এত দিন, এখন নিচে নামার পর আপনার ভোটার আইডির ব্যবহারও কমল। যাও–বা একটা ব্যাংক হিসাব খোলার কথা ভেবেছিলেন, এখন তো তিনবেলা খাবার জোটানোই কঠিন। হ্যাঁ, মুঠোফোন অবশ্য সময়ের চাহিদা মেটাতেই কমবেশি সবাই ব্যবহার করেন।
আপনাকেও করতে হয়। কিন্তু আপনি তো সাক্ষর নন, তাই আপনার মুঠোফোনে আসা দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতির খুদে বার্তাগুলো পড়ে অবহিত হতে পারেন না। তেমনি কীভাবে নানা ফন্দিফিকিরে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, নানা কৌশলে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে, সে কথাও আপনার অগোচরেই থাকে। কয়েকজন পি কে হালদার, সাহেদ-মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুদের সিন্ডিকেট, পাপিয়া-সম্রাটদের গং, এনু-রুপন বা রুবেল-বরকত ভ্রাতৃদ্বয়দের আঙুল ফুলে ‘ছোট’ কলাগাছ হওয়ার নমুনা ইত্যাদি বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা হঠাৎ হঠাৎ কানে আসে বৈকি, কিন্তু ঠিক ঠাওর করতে পারেন না। একইভাবে বুঝতে পারেন না, কীভাবে আপনি অজান্তেই দিন দিন ধনী হয়ে উঠছেন।
আপনার মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ ডলার। এ কথা শুনে একটু ধন্দে পড়তে পারেন বৈকি। ভোট না দিতে পারলেও আপনি যেমন ‘ভোটার’, জীবন চালাতে হিমশিম খাওয়া আপনার আয়রোজগারের হিসাব তেমনি ফুলেফেঁপে একাকার!
হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]