খাদ্যের দামের লাগাম টানতে আসলে যেখানে হাত দিতে হবে

করোনা মহামারি শেষ হতে না হতেই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য পাওয়ার আশায় শহরের নিম্নবিত্ত মানুষ, এমনকি মধ্যবিত্তের অনেকেই টিসিবির গাড়ির পেছনে ছুটছেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বাড়ার পাশাপাশি টিসিবির গাড়ির পেছনে মানুষের এই ভিড় দীর্ঘ হচ্ছে। তাই দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেককে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। বিষয়টি ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির নাজুক পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

একদিকে ক্রমবর্ধমান মাথাপিছু আয়ের সুফল সাধারণ জনগণ কতটুকু ভোগ করতে পারছেন, তা নিয়ে যেমন সমালোচনা বাড়ছে, অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। এমতাবস্থায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই টাস্কফোর্স গঠনের কথা ভাবা হচ্ছে। অন্যদিকে এক কোটি পরিবারকে বিশেষ কার্ডও দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে কয়েকটি নিত্যপণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে পাচ্ছে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ। কিন্তু এগুলো আপৎকালীন সমস্যা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টামাত্র। এটি সাময়িকভাবে সমাধান হলেও সমস্যার গভীরে হাত না দিলে স্থায়ীভাবে এ সংকট থেকে দেশ মুক্ত হতে পারবে না। তাই সমস্যার তল খুঁজে তার মূলোৎপাটন করতে হবে।

খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির বিশ্লেষণে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী বা আড়তদারদের অবৈধভাবে পণ্য মজুতের বিষয়টি সাধারণত সামনে আসে। তা ছাড়া পেঁয়াজ-রসুনসহ কিছু খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে যেসব দেশ থেকে তা আমদানি করা হয়, সেসব দেশের রপ্তানিনীতি পরিবর্তনকেও দায়ী করা হয়। এসবের সঙ্গে এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধিকেও দায়ী করা হচ্ছে। ফড়িয়া, আড়তদার, পাইকার, ক্ষুদ্র কারবারিসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং গণপরিবহন–ব্যবস্থায় অবৈধ চাঁদাবাজি তো আছেই। যার কারণে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে পণ্যের দামে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ গুণ পার্থক্য দেখা যায়।

কিন্তু এগুলো মূলত সমস্যার আইসবার্গের (হিমশৈলের) ওপরের অংশমাত্র। সমস্যার মূলে প্রথমে রয়েছে কৃষিজমির পরিমাণ দ্রুত কমে যাওয়া। ফলে চাল, ডালসহ প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে চাহিদার তুলনায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। অন্যদিকে খাদ্যশস্য উৎপাদন লাভজনক না হওয়ায় অনেক কৃষক এখন ফলমূল ও অর্থকরী ফসল উৎপাদনে বেশি ঝুঁকছেন। এর ফলেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে ভাটা পড়ছে। তবে বিগত কয়েক দশকে বোরোসহ উচ্চফলনশীল খাদ্যশস্যের আবাদ বৃদ্ধি এবং একই জমিতে একাধিকবার ফসল উৎপাদনের হার বৃদ্ধির ফলে হেক্টরপ্রতি ফসল উৎপাদন বহু গুণ বেড়েছে। আর সরকারের উদার আমদানিনীতি তো আছেই। ফলে খাদ্যশস্যের ঘাটতিজনিত সমস্যার তীব্রতা তেমন অনুভূত হয়নি।

আমাদের ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয়—সব অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে কৃষিজমি বলির পাঁঠা হচ্ছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এবং নিম্নমানের অবকাঠামো গড়ে উঠছে। তাহলে কি আমাদের প্রপৌত্ররা উত্তরাধিকার সূত্রে কৃষিজমিহীন ইট, পাথর ও কংক্রিটের একটি আস্ত জঙ্গল পেতে যাচ্ছে?

রাস্তাঘাট ও মহাসড়ক নির্মাণ, যত্রতত্র বসতবাড়ি নির্মাণ, শিল্পায়ন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে দেশ প্রতিবছর প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর কৃষিজমি হারাচ্ছে। যেমন ধরুন, কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে বিলের মাঝখান দিয়ে পাকা রাস্তা কিংবা মহাসড়ক নির্মাণ করা হলো। বছর ঘুরতেই এই পাকা রাস্তা বা মহাসড়কের দুই পাশে দোকানপাট ও বসতবাড়ি গড়ে উঠতে দেখা যায়। সময়ের পরিক্রমায় এর পরিসর বাড়তে বাড়তে একসময় পুরো বিলই হারিয়ে যায়। আবার কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা হাসপাতাল নির্মাণ করা হলো। কয়েক বছরের ব্যবধানে এসব স্থাপনার চারপাশের কৃষিজমিতে অপরিকল্পিতভাবে বসতবাড়ি গড়ে ওঠে। আজ যেখানে ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে ঠাসা, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিতে ফিরে গেলে দেখতে পাব সেসব এলাকায় ছিল সবুজ ফসলের মাঠ।

১৯৭১ সালের তুলনায় বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় তিন গুণ। এই বাড়তি মানুষের বসতভিটা বানাতে ক্রমেই মানুষ ফসলি জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে। তা ছাড়া শিল্পকারখানার জন্য কৃষিজমির ব্যবহার তো আছেই। ইদানীং ধনিক শ্রেণির রিসোর্ট, বাংলো বা বাগানবাড়ি তৈরির শখও কৃষিজমি ধ্বংসের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। মোদ্দাকথা, আমাদের ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয়—সব অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে কৃষিজমি বলির পাঁঠা হচ্ছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এবং নিম্নমানের অবকাঠামো গড়ে উঠছে। তাহলে কি আমাদের প্রপৌত্ররা উত্তরাধিকার সূত্রে কৃষিজমিহীন ইট, পাথর ও কংক্রিটের একটি আস্ত জঙ্গল পেতে যাচ্ছে?

আরও পড়ুন

সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই পরিস্থিতির আশু মোকাবিলা করতে না পারলে বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ৫০ বছরে কৃষিজমি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং দেশ স্থায়ী খাদ্যঝুঁকিতে পড়বে। তা ছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতি একেবারে ধসে যাবে। মনে রাখা প্রয়োজন, কৃষিসহ গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তিশালী অবস্থানের ফলে অর্থনীতিতে করোনার আঘাত তেমন টের পায়নি। তাই যেকোনো মূল্যে কৃষিজমি বাঁচাতে আমাদের সর্বোচ্চ উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য ব্যাপক জনসচেতনতার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারেব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ইউনিয়ন পরিষদকে সংশ্লিষ্ট করাসহ ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনি কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সরকারি স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে তিন ফসলি ও দুই ফসলি জমি অধিগ্রহণ একপ্রকার নিষিদ্ধ হলেও সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় বিষয়টির প্রতিফলন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। তাই সরকারি ও বেসরকারি যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে তিন ফসলি এবং দুই ফসলি জমির ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করাও প্রয়োজন।

  • ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

আরও পড়ুন