২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকির মুখে সারা বিশ্ব

খাবারের দাম আগে থেকেই বেশি হয়ে ছিল। সাম্প্রতিক যুদ্ধের পর, বিশেষ করে গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেল ও সারের দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছেছবি : রয়টার্স

সম্প্রতি খাদ্যনিরাপত্তার কথাটা বিশ্বব্যাপী সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। বিষয়টিতে ঢোকার আগে চকিত রেখায় এর পটভূমিটা দেখে নেওয়া যাক। কোভিড-১৯ আমাদের জীবনে তার মারাত্মক কামড়ের দাগ রেখে গেছে। এই অতিমারির আগে থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, জাতিগত সংঘাত ইত্যাদির কারণে পৃথিবীর নানা স্থানে ক্ষুধার মাত্রা তীব্র হয়ে উঠছিল। অতিমারি যুগপৎ মানুষের আয় কমিয়ে দিল এবং খাদ্যের সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করল। পরিস্থিতি হয়ে উঠল তীব্রতর।

গ্লোবাল নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে আনুমানিক ১৬ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হয়েছে। এর ঠিক আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। শুধু তা-ই নয়, ২০২১ সালে প্রায় ২৩ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণে ‘চাপগ্রস্ত’ হয়। ২০২০ সালের চেয়ে এমন মানুষের পরিমাণও ৭ শতাংশ বেশি।

বিশ্বব্যাংকের একটা সমীক্ষা বলছে, ৮৩টি দেশে কোভিড-১৯ অতিমারির প্রথম দুই বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ খাদ্যাভাবে পড়েছে, অর্থাৎ তাদের খাওয়া কমিয়ে দিতে হয়েছে। আরেকটি সূচকে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের সারাটা বছর প্রায় ২৩৭ কোটি মানুষের নিয়মিত খাবারের জোগান ছিল না। তারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তা এবং পুষ্টি অবস্থার প্রতিবেদন ২০২১ অনুযায়ী, ২০২০ সালে পৃথিবীর ৭২ থেকে ৮১ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। ২০২১ সালে যে ১৬ কোটি মানুষ সংকটাপন্ন ছিল, তাদের মধ্যে প্রায় ১৩ কোটিই বিভিন্ন যুদ্ধ-সংঘাত বা সহিংসতার মধ্য দিয়ে গেছে।

এ সংকটাপন্ন চিত্রে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো চেপে বসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকির কথা বিশ্লেষকেরা বলছেন। যুদ্ধের কারণে শস্যের স্বল্প সরবরাহ, জ্বালানি ও সারের মাত্রাতিরিক্ত দাম এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ বন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে খাবারের দাম সামনের সময়টাতে বাড়বে, কোনো কোনো জায়গায় খাবারের অভাব দেখা দেবে এবং লাখ লাখ লোককে না খেয়ে থাকতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দুর্বল মানুষের দুর্ভোগ যেন আর না বাড়ে, সে জন্য পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রগুলোকে বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেওয়াসহ খাদ্য ও সার রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়াও একান্ত জরুরি

বস্তুত, খাবারের দাম আগে থেকেই বেশি হয়ে ছিল। সাম্প্রতিক যুদ্ধের পর, বিশেষ করে গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেল ও সারের দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষ নিদারুণভাবে চাপগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, উচ্চ আয়ের দেশের তুলনায় এসব দেশের মানুষ তাদের আয়ের মোটা অংশই খাদ্যের পেছনে খরচ করে।

ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য, উৎপাদন ও সরবরাহকে যেভাবে বদলে দেবে বা ব্যাহত করবে, তাতে ২০২৪ সালের শেষ দিকে খাদ্যের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাকে চরম মাত্রার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়ার বড় এক কারণ প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। প্রাকৃতিক গ্যাস নাইট্রোজেন সারের মূল উপাদান। রাশিয়া ও বেলারুশই ছিল প্রধান সার রপ্তানিকারক। সারা দুনিয়াতে তারাই পটাশ–জাতীয় সারের ৩৮ শতাংশ, যৌগিক সারের ১৭ শতাংশ এবং নাইট্রোজেন সারের ১৫ শতাংশের সরবরাহকারী। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে, এ বছরের জানুয়ারির তুলনায় মার্চে সারের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। এতে আমদানি করা সারের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে। সামনের দিনগুলোয় সারের প্রাপ্যতা আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বিভিন্ন খাদ্যের উৎপাদনে।

আরও পড়ুন

এ পরিস্থিতিতে গত ১৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রধানেরা এক যৌথ বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলা করতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন; দুর্বল দেশগুলোয় বাণিজ্য উন্মুক্ত রাখা এবং তাদের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে অর্থ অনুদানের প্রস্তাব রেখেছেন। তাঁরা বলেছেন, খাদ্যনিরাপত্তাহীন দেশগুলোকে দ্রুত সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় তাদের সহায়তা করতে আমরা দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় অংশীদারদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে প্রস্তুত।

খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ হ্রাসের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে এরই মধ্যে ভঙ্গুরতার শিকার রাষ্ট্রগুলো, সামাজিক উত্তেজনার শিকার হতে পারে। সে কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সহায়তায় জরুরি খাদ্য সরবরাহ এবং ভঙ্গুর ও সংঘাতময় পরিস্থিতির শিকার দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা, তাৎক্ষণিক খাদ্য সরবরাহ, সহজ ও নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য, টেকসই খাদ্য উৎপাদন এবং পুষ্টিনিরাপত্তায় বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। তবে সর্বাগ্রে তারা দরিদ্রদের জন্য নিরাপত্তাজাল এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য অর্থায়নের সুবিধা দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দুর্বল মানুষের দুর্ভোগ যেন আর না বাড়ে, সে জন্য পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রগুলোকে বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেওয়াসহ খাদ্য ও সার রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়াও একান্ত জরুরি।

  • মো. মহসীন আলী ও আসফিয়া আজিম পুষ্টি বিশেষজ্ঞ