খাদ্য উৎপাদনের সাফল্য থেকে যেন ছিটকে না যাই

জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অল্পতা ও চাষযোগ্য জমির ক্রমসংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন মোটা ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন, ২০২০ সালে তা সাড়ে তিন গুণ বেড়ে ৩ কোটি ৮২ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে।

ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ টন। ৭০ লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১ কোটি ২ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।

গরুর মাংস ও দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও মাংস উৎপাদনে কয়েক বছরের মধ্যেই স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা যাবে বলে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার সময় অতীতে চোরাচালানে আসা ভারতীয় গরু যতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত, এখন তার প্রয়োজন হয় না; বরং মাঝেমধ্যে কোরবানির গরু উদ্বৃত্ত থাকছে।

ছাগল উৎপাদনে আমরা উদ্বৃত্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছি। আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কাঁঠালের মতো কয়েকটি প্রধান ফল উৎপাদনেও এখন বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে; যদিও বিদেশ থেকে নানা রকম ফল আমদানি ক্রমেই বাড়ছে। আমরা প্রতিবছর ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন গমও আমদানি করি। জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ার কারণে ভবিষ্যতেও গম ও ফল আমদানি বাড়তে থাকবে। কারণ, ময়দাভিত্তিক খাদ্যদ্রব্য ও বিদেশি দামি ফল জনগণের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হওয়াই স্বাভাবিক। তবু এটা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশে একটি কৃষিবিপ্লব চলমান।

কৃষি খাতের সমৃদ্ধি বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি বদলে ফেলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে। স্বাধীনতার উষালগ্নে বাংলাদেশ আদৌ টিকতে পারবে কি না, সে সম্পর্কে বিশ্ববাসীর যে প্রবল আশঙ্কা ছিল, তার প্রধান কারণই ছিল তখনকার খাদ্য ঘাটতির ব্যাপকতা। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শাসকদের অচিন্তনীয় অবহেলা, বৈষম্যমূলক শোষণ ও অবর্ণনীয় বঞ্চনার শিকার হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান পঞ্চাশের দশকেই ক্রমবর্ধমান ‘খাদ্যশস্য ঘাটতি অঞ্চলে’ পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানের পুরো ২৪ বছরেই পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি উন্নয়ন অবহেলার শিকার হয়ে স্থবিরতার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছিল; খাদ্য ঘাটতি বাড়তে বাড়তে ১৯৭০ সালে প্রায় ৩৫ লাখ টনে পৌঁছে গিয়েছিল।

মনে রাখতে হবে, বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে খাদ্য সাহায্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হয়েছিল। তদানীন্তন ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, তুরস্ক, ফিলিপাইন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সাহায্যের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপিত হয়েছে ইউএসএআইডির সাবেক কর্মকর্তা টেরেসা হেয়টার রচিত বিশ্বের বেস্টসেলার এইড অ্যাজ ইমপেরিয়ালিজম গ্রন্থে। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী বগুড়ার শাসনামলেই শুরু হয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খাদ্য সাহায্যের মরণফাঁদে পূর্ব পাকিস্তানের বন্দী হওয়ার ট্র্যাজিক ইতিহাস।

খাদ্য সাহায্য এখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। খাদ্য সাহায্যের মরণচক্র থেকে জাতিকে উদ্ধার করেছে এ দেশের কৃষকসমাজ; চলমান কৃষিবিপ্লবের জন্য তাদের অভিনন্দন।

ওই পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য ঘাটতি তেমন বেশি না থাকলেও পাকিস্তানের ভুল নীতি, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে প্রথমবারের মতো ১৯৫৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান ‘খাদ্যশস্য ঘাটতি অঞ্চলে’ পরিণত হয়েছিল। সস্তায় পাওয়া খাদ্য দিয়ে শুরু করা হয়েছিল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম ও টেস্ট রিলিফ, সম্প্রসারিত হয়েছিল রেশনিং। ষাট ও সত্তরের দশকে বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, খাদ্য সাহায্য না পেলে পূর্ব পাকিস্তানে/বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জনসন নামের যুক্তরাষ্ট্রের এক কূটনীতিক স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিক্সনের তদানীন্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার তাতে সায় দিয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেবে না বলে প্রাথমিক অবস্থান নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। কিন্তু পরে তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেন। অনেকে মনে করেন, বিশাল খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার ভয় বঙ্গবন্ধুকে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রকট খাদ্য ঘাটতি ও অর্থনৈতিক সংকটের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংক।

প্রথমে পাকিস্তানের ঋণের দায় নিতে হবে দাবি জানিয়ে কালক্ষেপণের চাণক্যনীতি গ্রহণ করেছিল তারা। পরে বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাটের বস্তা রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্র-আরোপিত অবরোধ কেন লঙ্ঘন করল, তার কৈফিয়ত চেয়ে ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যবাহী কয়েকটি জাহাজকে সাগরের যাত্রাপথ থেকে আদেশ দিয়ে বিভিন্ন দেশের বন্দরে নোঙর করে যাত্রা বিলম্বিত করতে বাধ্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওই জাহাজগুলো সময়মতো বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারলে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়তো এড়ানো যেত। কূটনৈতিক চ্যানেলে দুঃখ প্রকাশ করে কয়েক মাস পর মার্কিন খাদ্য সাহায্য পুনরায় চালু করা গেলেও সরকার দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারেনি।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বই মেকিং অব আ নেশন বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিস্টস টেইল-এ এই কাহিনির বর্ণনা রয়েছে। প্রধানত, এ জন্যই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার অনেক সাধ্য-সাধনা করে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিল, যাতে বাংলাদেশ এর ফলে বৈদেশিক খাদ্যসহায়তা ও ‘সফট লোন’ পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ বিবেচনা পায়। চরম খাদ্যশস্য ঘাটতি এবং বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কারণে বঙ্গবন্ধু ওই পর্যায়ে বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানকে এবং বিশেষত খাদ্য অনুদানকে অপরিহার্য বিবেচনা করেছিলেন।

এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশে বৈদেশিক সাহায্যের বান ডেকেছিল, যার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই থাকত খাদ্য সাহায্য। পুরো আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছে নতজানু থাকতে হতো খাদ্য ঘাটতি পূরণের মূল চাবিকাঠি তাদের কাছে থাকার কারণে। ১৯৫৭ সালের ৪২ বছর পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে; কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগ আমলের কৃষিনীতি পরিত্যাগ করায় আবার দেশে খাদ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য সাহায্যও বেড়ে গিয়েছিল।

২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশের খাদ্যশস্যের মজুতকে বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে ফেলায় ২০০৭ সালের শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ফলন-বিপর্যয় ও খাদ্য মজুতের স্বল্পতার কারণে দেশ আরেকটি দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। অবশেষে বর্তমান সরকারের নিষ্ঠাবান প্রয়াসের ফলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।

১৯৭২ সালে দেড় কোটি টন ধান লাগত আমাদের, অথচ উৎপাদন করতে পারতাম ১ কোটি ১০ লাখ টন। গত বছর এ দেশে ৩ কোটি ৮২ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। ১৭ কোটির বেশি মানুষের খাদ্যশস্য জোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতিবছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। খাদ্য সাহায্য এখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। খাদ্য সাহায্যের মরণচক্র থেকে জাতিকে উদ্ধার করেছে এ দেশের কৃষকসমাজ; চলমান কৃষিবিপ্লবের জন্য তাদের অভিনন্দন।

মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক