নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য স্থানিক পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক নগর-পরিকল্পনা কমপক্ষে দুই ধাপে করা হয়—স্ট্রাকচার বা কাঠামোগত পরিকল্পনা ও এর আলোকে প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। কাঠামোগত পরিকল্পনায় পরবর্তী ২০ বছর সময়ের জন্য শহরের পরিসর, জনসংখ্যা, অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধার ধরন, ব্যাপ্তি ও অবস্থানের নীতিমালা ও কৌশল তৈরি হয়। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা সে নীতি ও কৌশলকে স্থানিক পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে। রাজউক ১ হাজার ৬২৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকার খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫ প্রণয়ন করে গণশুনানির ব্যবস্থা করেছে। নগর-পরিকল্পনাবিদ হিসেবে প্রস্তাবিত খসড়াকে উপজীব্য করেই আমাদের এই লেখা।
শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, আলোচ্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার পূর্ববর্তী ধাপ কাঠামোগত পরিকল্পনাটির খসড়া তৈরি হলেও তা এখনো গেজেটভুক্ত হয়নি। এমতাবস্থায় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিকভাবে অভিভাবকহীন; যা অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার শামিল।
ঘনত্বভিত্তিক জোনিং ও ভূমির মিশ্র ব্যবহার
জনসংখ্যা, জনঘনত্ব, প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম দেশের অন্য শহরের তুলনায় ঢাকায় অনেক বেশি বিধায় আবাসন খাত এখানে যথেষ্ট সক্রিয়। এ কারণেই ভবন নির্মাণ, অনুমোদন ও ব্যবহারের নীতিমালার যেকোনো পরিবর্তন আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। ফলে খসড়া পরিকল্পনার ঘনত্বভিত্তিক জোনিং ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারের প্রস্তাব জনমনে বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে।
ঘনত্বভিত্তিক জোনিং একটি আধুনিক, বহুমাত্রিক ও সামষ্টিক ধারণা। বিশ্বের নানা শহরে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ও ঘনত্বভিত্তিক জোনিংয়ের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করা হয়। খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় এফএআরের ব্যাপারে অস্পষ্টতা রেখে কেবল ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে শুধু ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, এর পক্ষে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুপস্থিত। ঘনত্বভিত্তিক জোনিংয়ের অসম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপনের ফলে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালামতে এলাকাভেদে এফএআরের প্রয়োগের কোনো ভিন্নতা নেই। এফএআরের প্রয়োগে বিদ্যমান জনসংখ্যা, অবকাঠামো ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অসমতা বিবেচনা না করার ফলে বিভিন্ন এলাকার বাসযোগ্যতার ক্রমাবনতি ঘটেছে। সুতরাং ঢাকার জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ ও যৌক্তিক বণ্টনের জন্য তথ্য-উপাত্তনির্ভর সিদ্ধান্ত ও কর্মপরিকল্পনা না নেওয়া গেলে এফএআর বা ঘনত্বভিত্তিক জোনিংয়ের সুফল পাওয়া যাবে না।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে পরিকল্পনাবিদেরা ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করছেন। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের শহরে ভূমির মিশ্র ব্যবহারই প্রচলিত। কিন্তু গত ৫০/৬০ দশক হতে যেসব নতুন এলাকার (যেমন ধানমন্ডি, তেজগাঁও) উন্নয়ন হয়েছে তাতে পাশ্চাত্যের অনুসরণে ভূমির একক ব্যবহার দেখা যায়। মিশ্র ব্যবহারের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত অনেক সুবিধা আছে। কিন্তু ঢালাওভাবে মিশ্র ব্যবহার উপকার থেকে অপকারই বেশি বয়ে আনবে। খসড়া অনুসারে একই ভবনের বিভিন্ন তলায় বিভিন্ন ব্যবহার করা যাবে; ২০ থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত যেকোনো প্রশস্ততার রাস্তার পাশে ভবনের ফ্লোর এরিয়ার আকার সাপেক্ষে বিভিন্ন মাত্রায় মিশ্র ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে ভবনের ব্যবহার অনুমোদনের ক্ষেত্রে অরাজকতা তৈরি হবে। আবার শর্ত সাপেক্ষে ব্যবহার অনুমোদন করার কথা বলা থাকলেও শর্তগুলো সুস্পষ্ট করা হয়নি, যা রাজউকের দুর্বল অনুমোদন ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করবে—নীতিবিরুদ্ধ কাজের আশঙ্কা তৈরি হবে। এ ছাড়া বলা হয়েছে, নির্ধারিত ফি দেওয়ার মাধ্যমে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার (যেমন পূর্বাচল, গুলশান) যেকোনো প্লটকে অনাবাসিক ব্যবহারে রূপান্তরিত করা যাবে। তাই যেকোনো আবাসিক ভবনের পাশের প্লটে গড়ে উঠতে পারে চকলেট কারখানা থেকে শুরু করে পানীয়, কার্বোনেটেড পানীয় প্রস্তুত ও বোতলজাত করার কারখানা। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, এতে শহরের বাসযোগ্যতা আরও কমবে। অথচ মিশ্র ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দূষণ কমানো, সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, যানবাহনের ব্যবহার সীমিত করার মাধ্যমে শহরের বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করা।
নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের আবাসন
নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের আবাসনের প্রস্তাব যেভাবে আলোচ্য খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় উল্লেখিত হয়েছে, তা কোনোভাবেই এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা, সূচকসমূহ, সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, উন্নয়ন নীতিমালাগুলো বিশেষত জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালার লক্ষ্যগুলো পূরণে সহায়ক হবে না। এমনকি প্রস্তাবিত ঢাকা অবকাঠামো পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫, যা এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার উচ্চতর ভিত্তি, তার আবাসনবিষয়ক নীতিও উপেক্ষিত হয়েছে।
ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে। কিন্তু এই বিপুল জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থান এবং তাদের বাসস্থানের স্থানিক, সাংখ্যিক ও প্রকৃতিগত বিশ্লেষণ এ খসড়াতে নেই। এই পরিকল্পনাতে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের আবাসনের জন্য (মানচিত্রে বিন্দু হিসেবে) এগারটি (১১) সম্ভাব্য স্থানের উল্লেখ থাকলেও স্থানগুলোর আয়তন ও মৌজাভিত্তিক অবস্থান খসড়ায় অনুপস্থিত। অথচ মানবিক ও ন্যায্য নগর গড়ে তুলতে হলে এ জনগোষ্ঠীর অধিকার, চাহিদা, সামর্থ্য, তাদের কাজের ক্ষেত্র, অর্থনীতিতে তাদের অবদান প্রভৃতি বিবেচনায় নিয়ে আবাসন খাতের পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক।
পরিবহন ও যোগাযোগ
খসড়া পরিকল্পনায় গণপরিবহন, পথচারী ও অযান্ত্রিক বাহনকে নীতিগতভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনায় এসব নীতির প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। পরিবহন অবকাঠামো এবং ভূমি ব্যবহারের সংযোগ ও সমন্বয়, ট্রানজিট-ভিত্তিক উন্নয়ন, করিডোর-ভিত্তিক উন্নয়নের সুস্পষ্ট কোনো বিশ্লেষণ, কর্মপরিকল্পনা ও উদাহরণ এতে অনুপস্থিত। যেমন উচ্চতর পরিবহন পরিকল্পনা অনুযায়ী এয়ারপোর্ট এলাকায় একটি বহুমাধ্যমভিত্তিক স্টেশন হবে, যেখানে বিআরটি, এমআরটি, ইন্টারসিটি রেলওয়ে, অভ্যন্তরীণ বাস প্রভৃতির সংযোগ হবে। আমরা আশা করেছিলাম খসড়া পরিকল্পনায় সে আলোকে এয়ারপোর্টের আশপাশের পরিবহন ব্যবস্থা, ভূমি ব্যবহার উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের কর্মপরিকল্পনা থাকবে; কিন্তু এটি অনুপস্থিত। অনুরূপভাবে, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত ব্লকের পথচারী, অযান্ত্রিক বাহন ব্যবহারকারীরা কীভাবে বিআরটি/এমআরটি স্টেশনগুলোতে আসবেন, তার জন্য রাস্তার আকারভেদে সন্নিহিত স্থাপনার আকার, ব্যবহার কী হবে প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়েও কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন প্রয়োজন ছিল।
বাস্তবায়নাধীন সরকারি ও বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পগুলো গণপরিবহন, পথচারী ও অযান্ত্রিক বাহনবান্ধব নয়। প্রস্তাবিত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ওই এলাকাগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দুর্ভাগ্যজনকভাবে খসড়া পরিকল্পনায় পথচারীদের নিরাপত্তা যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়। যে শহরে পথচারীরা সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান শিকার, সে শহরে বাসে ওঠার জন্য মাত্র চার ফুট প্রশস্ত ফুটপাথের প্রস্তাব যথেষ্ট বিপজ্জনক ও অপরিণামদর্শী।
জলাভূমি ও প্রতিবেশ
বন্যার ঝুঁকি, জলাবদ্ধতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ক্রমবর্ধমান নিম্নগামিতা, ধ্বংসপ্রায় জীববৈচিত্র্য এবং সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ঢাকার জলাভূমির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দেশের বিদ্যমান আইন এবং মহাপরিকল্পনা ভঙ্গ করে ঢাকার চতুর্দিকে চলছে জলাভূমি দখলের অপসংস্কৃতি। এই খসড়ায় যদিও উল্লেখ করা নেই, তবুও সবাই জানি এক শ্রেণির ভূমিদস্যুর অমানবিক অত্যাচারে জলাভূমির মালিক ও স্থানীয় লোকজন আজ বাস্তুচ্যুত, যাদের অধিকাংশই বিত্তহীন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। খসড়া পরিকল্পনার অন্যতম মূলনীতি ‘প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবন’, যা প্রশংসনীয়। এই নীতির আলোকে নদী বা খাল-তীরবর্তী এলাকা, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ৫০ বা ২৫০ মিটার বলয় (বাফার) দ্বারা চিহ্নিত করা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বরং খসড়া পরিকল্পনার অনেক প্রস্তাব জলাভূমিসংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও খসড়া পরিকল্পনার মূলনীতিরও পরিপন্থী; কৃষিকাজ, জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
খসড়া পরিকল্পনায় অনেক জলভিত্তিক পার্কের অবস্থান মানচিত্রে বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত আছে। এগুলোর মৌজাভিত্তিক নির্দিষ্টকরণ প্রয়োজন। তদুপরি এগুলোর মালিকানা, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনা কী হবে, এ বিষয়ে এই পরিকল্পনায় কোনো আলোকপাত করা হয়নি।
প্রস্তাবিত নীতিমালায় মুখ্য জলস্রোত এলাকা ছাড়া বাকি দুই শ্রেণি—সাধারণ প্লাবনভূমি ও সাধারণ জলস্রোত এলাকার ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ভূমির ব্যবহার পরিবর্তন ও এতে স্থাপনা অনুমোদনের কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাব অনুসারে সাধারণ জলস্রোত ও সাধারণ প্লাবনভূমিকে শর্ত সাপেক্ষে অন্য ব্যবহারে রূপান্তরিত করা যাবে। এটি বাস্তবায়িত হলে রাজউক এলাকার ৬৬ শতাংশ প্লাবনভূমি সংকুচিত হয়ে ১৭ শতাংশে নেমে আসবে; জলাভূমির প্রাকৃতিক নেটওয়ার্ক, চরিত্র, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে; আকাঙ্ক্ষিত নীল জীবনরেখা বা ‘ব্লু নেটওয়ার্ক’ আর থাকবে না। উল্লেখ্য, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বন্যা প্রবাহ অঞ্চলের নতুন করে শ্রেণিবিন্যাস করা যাবে না, একে এককভাবে বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল হিসেবেই দেখাতে হবে। একই রায় অনুযায়ী বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলকে ওভারলে জোন হিসেবে দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। এসব মৌজায় কৃষি ছাড়া অন্য কোনো ধরনের ভূমি ব্যবহার অনুমোদন করা যাবে না। সর্বোপরি এই ভূমি ব্যবহারের নামকরণ অবশ্যই প্রচলিত আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
খসড়া পরিকল্পনায় অনেক জলভিত্তিক পার্কের অবস্থান মানচিত্রে বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত আছে। এগুলোর মৌজাভিত্তিক নির্দিষ্টকরণ প্রয়োজন। তদুপরি এগুলোর মালিকানা, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনা কী হবে, এ বিষয়ে এই পরিকল্পনায় কোনো আলোকপাত করা হয়নি। এখানে আরও উল্লেখ্য, ঢাকা ওয়াসার পরিকল্পনার সঙ্গে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন ছিল। এই পরিকল্পনার সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার পরিকল্পনা, পরিবেশসংক্রান্ত আইন ও ব-দ্বীপ পরিকল্পনার মধ্যে বৈরিতা লক্ষণীয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশ সরকার এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা এবং সেনদাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর গ্লোবাল ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন ২০১৫-২০৩০ পূরণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। উন্নয়নের সঙ্গে ঝুঁকি নিরসন একই সূত্রে গেঁথে জানমালের ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনা এবং ঝুঁকি-সহনীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা করা অত্যাবশ্যক। এ পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি একেবারেই ঊহ্য রয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বৃষ্টিজনিত বন্যা ও জলাবদ্ধতা এবং শহরে নদীবাহিত বন্যার ঝুঁকি বিবেচনা করে বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল, জলাধার, জলাশয়, খাল-বিল, নদীনালা ব্যবস্থাপনায় প্রাসঙ্গিক প্রস্তাব থাকা জরুরি ছিল।
মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বিশেষত অগ্নিকাণ্ড, ভবনধসের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা এই খসড়ায় অনেকটাই গুরুত্বহীন থেকে গেছে। উপরন্তু কোভিড-১৯-এর প্রেক্ষাপটে অতিমারি, মহামারির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল।
নগর অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য খাত
জাতি হিসেবে ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই। এই ক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজধানী ঢাকার ভূমিকা হবে সর্বাধিক। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে আমলে এনে এই পরিকল্পনা প্রণয়নে যে দূরদর্শিতার প্রয়োজন ছিল, তা অনুপস্থিত। বিশেষত ঢাকার আশপাশে অবস্থিত প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ এবং রাজউক ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাদের প্রভাব এবং অন্যান্য খাতের সঙ্গে তাদের সংযোগের বিষয়টি বিবেচনায় আনা দরকার ছিল।
বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার অভিভাবক পরিকল্পনা প্রস্তাবিত ঢাকা অবকাঠামো পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫-এ ঢাকার কর্মসংস্থান এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিবিষয়ক বেশ কিছু রূপরেখা উল্লেখ করা হয়েছে, যা এ খসড়ায় বিবেচিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। এ শহরের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে। অদূর ভবিষ্যতে এই চিত্রের খুব বেশি পরিবর্তন হয়তো হবে না। তাই এই অনানুষ্ঠানিক খাতকে উন্নয়ন ও পরিকল্পনার মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা অত্যাবশ্যক। বিষয়টি আলোচ্য পরিকল্পনায় ন্যূনতম গুরুত্ব পেয়েছে। অথচ, স্থানিক, আর্থসামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশদ পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল।
এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঢাকা শহরে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্পকারখানার অবস্থান, অবকাঠামোগত সুবিধা, কর্মস্থলের পরিবেশ, দূষণ এবং ভবিষ্যতে এসব শিল্পকারখানার কলেবর বৃদ্ধি অথবা সীমিত রাখা সংক্রান্ত নানা বিষয় এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার অবকাশ ছিল। অথচ এই খসড়ায় যেসব প্রস্তাব রয়েছে, তা শিল্প ও বাণিজ্য খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় শুধু অপ্রতুলই নয়, নিতান্তই প্রাথমিক বা অগভীরও বটে। বলে রাখা ভালো, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিক কারখানা এবং গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ ও তাগিদ রয়েছে এবং খসড়া পরিকল্পনায় তা সন্নিবেশিত করা দরকার ছিল।
পরিকল্পনা প্রণয়ন একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া ও বহুমাত্রিক কারিগরি বিষয়। আমরা মনে করি, প্রস্তাবিত খসড়া পরিকল্পনায় পূর্ববর্তী বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (২০১০-২০১৫) প্রয়োগ ও বাস্তবায়নসংক্রান্ত অর্জিত জ্ঞান এবং নগরায়ণ প্রক্রিয়া ও ঢাকার নগর জীবনের ভৌত ও আর্থসামাজিক বিশ্লেষণ-সম্পর্কিত গবেষণাগুলো যথার্থভাবে নথিভুক্ত করা ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আলোচ্য খসড়ায় তা অনুপস্থিত। এটা করার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাজউকের সক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
আমরা আরও মনে করি, নতুন নতুন প্রস্তাব, যেমন মিশ্র ব্যবহার, ঘনত্বভিত্তিক জোনিং প্রভৃতির যৌক্তিকতা যাচাইয়ের জন্য সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত ও ওয়ার্কিং পেপার জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা জরুরি। আসলে ঢাকা মেগাসিটির সমস্যাগুলো বিহিত করে একে ‘মানবিক’ ও ‘ন্যায্য’ নগরে রূপান্তর ও সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হলো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সুশাসন ও সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ ব্যাপারে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে উত্থাপিত যুক্তিতর্ক ও তথ্য-উপাত্তের নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করার মাধ্যমেই উপনীত হতে হবে যৌক্তিক এবং ন্যায়সংগত সিদ্ধান্তে।
মোহাম্মদ শাকিল আখতার, ইশরাত ইসলাম, আফসানা হক, মু. মোসলেহ্ উদ্দীন হাসান, এ কে এম রিয়াজ উদ্দীন, মো. নূরুল্লাহ, ইফাদুল হক: লেখকেরা নগর-পরিকল্পনাবিদ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষকতা, গবেষণা ও কর্মে নিয়োজিত