ঘুম থেকে উঠে কাগজের খোঁজ, আমাদের মতো বয়সী লোকদের আজীবন অভ্যাস। কাগজ বেরোয়নি, ঈদের ছুটিতে বাড়ি গেছে সংবাদপত্রের পুরো অফিসটাই। খবরের কাগজ বিলি করেন যাঁরা, তাঁদের নেই দেখা। যাওয়ার আগে বললেন, এবার ১০০ টাকা বকশিশে চলবে না স্যার, দিতে হতে ২০০। দিলাম। এক মাস পর সকালবেলা চা খেলাম জম্পেশ করে। সংবাদপত্রহীন টেবিলের সামনে টিভি। ওখানেই সব সংবাদ।
যা বলতে চেয়েছি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে অনেক সংবাদপত্র বেরোয়। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি পড়ে ফেলা যায় ভোররাত থেকেই ইন্টারনেটে। খবর নিয়ে জানতে পারা গেল যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কাগজ কিনছেন কমই। মজা পাওয়া যায় না যদিও, তবু এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে নিজ অজান্তে। পত্রিকার সার্কুলেশন বিভাগ নড়েচড়ে বসছে। খবরের কাগজ কি উঠে যাবে? সে রকমই অবস্থা এখনো হয়নি। পশ্চিমে মুদ্রিত সংবাদপত্রের চাহিদা কমলেও প্রাচ্যে কমেনি।
আমার নিজের কথা বলি। যে ম্যাগাজিন পয়সা দিয়ে কিনতাম, তার বেশ কয়েকটি বেরোয় দিল্লি, নিউইয়র্ক ও লন্ডন থেকে। অ্যান্ড্রয়েড স্মার্ট মোবাইল পাওয়ার পর থেকে সেগুলো কেনার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে না এই কারণে যে মূল প্রবন্ধ দিনের মধ্যে অন্তত দুবার ‘বিং নিউজ’ ও ‘সিএনএন’-এ পাচ্ছি, এনডিটিভির লেটেস্ট ভিডিওসমেত। সর্বক্ষণ মোবাইল নিয়ে চলাফেরা যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে আমার নাম ছিল না। এখন আছে, কারণ ‘প্রথম আলোর নিউজ’ [টাকার বিনিময়ে] প্রতিদিন অন্তত চারবার ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর মাধ্যমে পাচ্ছি। তাহলে খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনগুলোর কদর কি কমে যাচ্ছে না? যা মোবাইলে পাচ্ছি, সেগুলো অনুবাদে বসবেন আমাদের সংবাদপত্রকর্মীরা এইমাত্র, কাল খবরের কাগজে বেরোবে যা।
রায়ন টমাস গবেষণা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে, যা আমার সামনে উপস্থিত। বাকি শুধু সংবাদপত্রের মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা। ১০টি কারণের প্রধান হলো: টাকা চলে যাচ্ছে বৃদ্ধদের হাত থেকে নবীনদের ব্যাংকে। খরচের সুতা এখন ওদের হাতে। যেভাবে চাইবে, সেভাবে বদলে যাবে খরচের ফ্লো, যেমনিভাবে প্রতি নিকেল খরচ হয় ফেসবুক, আইপড, কোমল পানীয়তে। তার খবর আমাদের সংবাদপত্রের ডেমোগ্রাফিতে অনুপস্থিত। প্রিন্ট পাবলিকেশন এখনো নির্ভর আমাদের মতো বুড়োদের স্ট্যাটিসটিকস নিয়ে। ওতে সম্ভবত কাজ হবে না। দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্র, যা ছিল এককালে তরুণের উষ্ণ আবেগের ফসল, তেমনটি আর নেই। কবে যেন ওই আবেগ পালিয়ে গেছে জানালা দিয়ে।
ছিলাম পুরানা পল্টনে ৫০ বছর। সংবাদপত্রের কর্মী, স্টাফ রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক, সহসম্পাদক, সম্পাদকদের সঙ্গে দেখা হতো দিনে চৌদ্দবার। কী এক আশ্চর্য অনুভূতি তাঁদের কর্মকাণ্ডে। বাংলাদেশের প্রতিটি উত্তাল মানবিক কর্মকাণ্ডের যেন ওঁরা অতন্দ্র প্রহরী, ঘোরের মধ্যে চলত তাঁদের দিনকাল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অনেকেই, যাঁরা আজ ইতিহাসে আশ্রয় নিয়েছেন, যেমন: মধ্যরাতের অশ্বারোহী ফয়েজ আহ্মদ, আমৃত্যু সংবাদপ্রেমিক এবিএম মূসা, নির্মল সেন, এনায়েতুল্লাহ্ খান। ছিলেন দিনরাত্রির ফটোগ্রাফার। সবাইকেই চিনতাম। সাংবাদিকদের সেই আবেগের ঘটেছে মৃত্যু। তাই বলা যায়: সাংবাদিকতায় নেই সাংবাদিকতা। প্রতি সংবাদে আছে কতটুকু মানবতা, তার হিসাব কে করবে? কোথায় সাংবাদিকদের সেই মানবতাবোধ, রাজনীতির নিউজরুম ছাড়িয়ে যা প্রবেশ করে মানবিক নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্মে?
খবরের কাগজের দাম ছুটে চলেছে যেন রানারের মতো। ওটি আর নামবে না। যাঁদের পকেটে টাকা আছে, তাঁদের কাছে ১০-২০ টাকা কোনো টাকাই না। আর যাঁদের নেই, ওঁরা খবরের কাগজ পড়ার আনন্দ হারিয়ে ফেলছেন দিন দিন। দুই টাকার কাগজের দামও কয়েক দিন পর বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন কিছু কেউই দিতে সক্ষম হচ্ছেন না। প্রিন্টিং প্রেসের জন্য প্রয়োজন অনেক জায়গা, প্রয়োজন অনেক জঞ্জাল ফেলে দেওয়ার আয়োজন। তাই যাঁরা প্রফিট মার্জিনের খোঁজ করছেন, তাঁরা এখান থেকে পাবেন সামান্যই। এটা হলো সেই যুগ, যেখানে প্রবেশ করেছে ডিজিটাল মিউজিক, ডিআইওয়াই, ই-বুকস ও রিয়েলটি টিভি। সংবাদপত্রের ব্যবসায়ীরা ভাবছেন যে তাঁরা ওয়াল স্ট্রিট, বিগওয়েল ও বিগটোবাকোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলবেন। স্বয়ং আমেরিকাতেই সব কাগজ মাথায় হাত দিয়ে বসেছে।
তবে বাংলাদেশে এখনই দুশ্চিন্তার কারণ দেখি না। আমাদের দেশের সংবাদপত্রের দশা ওদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। যদিও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে কেবল নিউজ। তারা লেখাপড়াকে দিয়েছে নির্বাসন। এখন সাদামাটা রিপোর্ট চোখের সামনে প্রস্তুত দেশের ৩০টি চ্যানেলে, যার মধ্যে ১০টি নিউজ চ্যানেল। ওদের নিউজের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন খবর।
মানুষ শুধু নেগেটিভ খবর শুনতে চায় না। কোথায় কত লোক কত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল, তা নিয়ে কেউ বিব্রত নয়। নিউজ জানতে চায়, কীভাবে ফসল বেড়ে চলেছে, কীভাবে এ দেশের সাধারণ একজন মানুষ বিদেশে রপ্তানি করে রাতারাতি সম্পদ আহরণ করেছে, তার কাছে কী শিক্ষণীয় আছে, গৃহকোণের কোন নারী অসাধ্য সাধন করে তাঁর ছজন ছেলেমেয়েকে গ্র্যাজুয়েট করিয়েছেন, সেই খবরের দিকে এখন মানুষের চোখ, যা সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সংগ্রহ করছে প্রতিদিন। ইন্টারনেট অনেক মৃত্যুর জন্য দায়ী। তবে এর দায় প্রযুক্তির নয়, প্রযুক্তিকে যাঁরা অপব্যবহার করছেন, তাঁদের। প্রধানত একশ্রেণির মানুষ মনুষ্যত্বকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছে। সময় এসেছে এ নিয়ে ভাবার।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
[email protected]