খচখচ উসকানি আর নাকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ
জীবনের দাবি অনেক বেশি। তবু সামান্যটুকু মেটাতে ন্যূনতম শ্রম মজুরি ১৬ হাজার টাকার দাবিতে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরেই লড়ছেন এ দেশের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মজুরিতে বেশ অবহেলিত পোশাকশ্রমিকেরা। সব দিক বিবেচনায় এই শ্রম মজুরির দাবিও নিতান্তই কম। তবুও দফায় দফায় আন্দোলন, হামলা-মামলা, শ্রমিক নেতৃত্বের অনেক লড়াই, জেল ইত্যাদির পর মজুরি বাড়ার ঘোষণা আসে ২০১৮ সালের নভেম্বরে। না, ১৬ হাজার তো নয়ই বরং ৮ হাজার টাকা করতে মালিকপক্ষকে ‘গাই-গুই’ করতে হয়েছে। প্রতিবারই তা-ই হয়। নানা বাহানা, মালিকদের নানা ধরনের ‘এপাশ-ওপাশ’-এর মধ্য দিয়ে বাড়ে হয়তো কয়েক শ টাকা, কোনো কোনো মালিকের এক বেলার চা-কফির দাম, কিংবা তারও কম। ন্যূনতম মজুরির পাশাপাশি শ্রমিকেরা স্বচ্ছন্দ তো নয়ই বরং একটু মর্যাদা, নিরাপত্তা আর অধিকার নিয়ে কাজ করার দাবি করেছেন। তা-ও বারবার উপেক্ষিত হয়েছে, হচ্ছে ।
আট হাজার টাকা নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করে গত ২৫ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। নতুন করে পোশাকশ্রমিকদের জন্য সাতটি ও কর্মচারীদের জন্য চারটি গ্রেড নির্ধারণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়িভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ টাকা, খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা। চলতি মাস থেকে নতুন হারে মজুরি পাওয়ার কথা। গেজেটে বলা হয়েছে, কোনো শ্রমিককে এই ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম মজুরি দেওয়া যাবে না। এই মজুরির চেয়ে বেশি হারে মজুরি দিলে তা কমানোও যাবে না। শ্রমিকেরা প্রতিবছর মূল মজুরির ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন। মালিকেরা এ সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবেন বলেও গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৩ সালে যে সরকারি গেজেট বেরিয়েছিল সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে, প্রতিবছর শ্রমিকের বেতন ৫ শতাংশ করে বাড়াতে হবে।
কথা ছিল, কিন্তু সে কথা রাখা হয়নি। ক্ষমতাশালী কেউ ঋণখেলাপি হলেই যেখানে কোনো শাস্তি নেই, সেখানে কথাখেলাপি হলেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হয়েছে। কারণ শ্রমিকেরা নিরুপায় হয়ে প্রতিবাদে নেমেছেন। আশুলিয়ায়, মিরপুরে, সাভারে, টঙ্গীতে, নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। তারুণ্যের প্রথম প্রহরেই পোশাকশ্রমিক সুমনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। সুমন মিয়ারা আর বড় হয়ে উঠতে পারেন না, তাঁদের উঠতে দেওয়া হয় না, তার আগেই তারা ‘লাশ’ হয়ে ওঠেন। অথচ এই রাষ্ট্রের সুমনদেরই দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি।
দেশের জিডিপি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও সরকারের কাছে সবচেয়ে ‘বেয়াড়া’ এই শ্রমিকেরা। কারণ তাঁরা ‘যখন -তখন’ রাস্তায় নেমে আসেন। বাংলাদেশে যে খাতে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয় সেটি হলো গার্মেন্টস। এইতো বছরের শুরুতেই যখন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সবাই খোশ মেজাজে আছেন, তখন রাস্তায় নেমেই শ্রমিকেরা সেই মেজাজে ‘ছাই’ দিলেন। আওয়ামী লীগ নতুন করে ক্ষমতায় বসতে না বসতেই ‘ষড়যন্ত্র’? এই বিষয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, তৈরি পোশাক খাত অধ্যুষিত অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, চট্টগ্রাম ও টঙ্গী এলাকায় অবস্থিত পোশাক কারখানাগুলো এখন সরকারি নজরদারির আওতায় রয়েছে। আগেও ছিল, কিন্তু সরকার কখনো এ বিষয়ে খোলাসা করে বলেনি, কিন্তু এখন বলছে। শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই একটি মহল পোশাক খাতে অসন্তোষ সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে—এ ধরনের অভিযোগও নতুন নয়। এখন গার্মেন্টসগুলোতে নজরদারি বাড়িয়ে সরকার আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করছে।
আন্দোলন হলেই পোশাক কারখানার মালিকেরা তোতা পাখি হয়ে যান, বলতে থাকেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করতে শ্রমিকদের উসকানো হচ্ছে।’ এ ক্ষেত্রে সরকারের চোখ আরেক কাঠি এগিয়ে থেকে নতুন নতুন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করে। রানা প্লাজার মতো হৃদয় বিদীর্ণ করা ঘটনাকেও ‘ঝাঁকুনি’ তত্ত্ব দিয়ে মোড়কবদ্ধ করতে চায়।
শ্রমিকদের উসকায় কারা? তাঁরা নিজেরাই এই উসকানির স্রষ্টা। এ দেশের ৪০ লাখ শ্রমিক জানেন তাঁকে কেন বছর বছর দফায় দফায় লড়তে হয়। উসকানির জায়গা সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত। তাঁরাই জানেন তার আসল উসকানির সুড়সুড়ি তার মন থেকে আসা, বঞ্চনা থেকে আসা, ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে আসা। মজুরির আন্দোলন হঠাৎ করে হয়েছে কিংবা নির্বাচনের ফলাফলের কারণে হয়েছে, তা নয়। চলছিলই, মাঝখানে পড়ল নির্বাচন-বিরতি। তারপর তাঁরা যখন দেখলেন মালিকপক্ষের কথা আর কাজে মিলছে না, ধার্য করা ন্যূনতম বেতনটাও তাঁরা পাচ্ছেন না, তাঁরা চলে আসেন রাস্তায়, আন্দোলনে। তাদের আসতে হয়, হবে, এটা তাঁরা জেনে গেছেন আগেই।
এখানে ষড়যন্ত্র আছে, আর সেই ষড়যন্ত্রের গুরু স্বয়ং কোনো কোনো মালিক, যাঁরা গেজেট বের হওয়ার পরও ধার্য মজুরি দেন না, দিতে চান না। শ্রমিকের মজুরি ঠিকমতো না দেওয়াই তো আসল ষড়যন্ত্র। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের ধারায় ২৮৯ ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে, ‘কোনো মালিক একাদশ অধ্যায়ের অধীন ঘোষিত নিম্নতম মজুরি হারের কম হারে কোনো শ্রমিককে মজুরি প্রদান করলে, তিনি এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।’ সরকার যখন শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্র খোঁজেন তখন কী একবারের জন্য যে মালিক শ্রমিককে কম মজুরি দিতে চান তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে? যখন দুই ঈদে বকেয়া মজুরি পাওয়ার জন্য, একটুখানি সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানোর জন্য, অতি সামান্য প্রাপ্য মজুরির জন্য রাস্তায় মরার জন্য বুক পেতে দেন, সেখানেও সরকারি নাক খালি ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজে।
যাঁরা শ্রমিককে ধার্য মজুরি দিতে চান না, তাঁরাই ষড়যন্ত্রকারী। আর যদি শ্রমিকের ন্যায্য আন্দোলনকে উসকানি হিসেবে পাঠ করেন তাহলে বলব, এই উসকানি মানুষ হয়ে বাঁচতে শেখার লড়াইয়ের পাঠ বাতলে দেয়। তাই তারুণ্যের ভোর দেখা সুমনেরা লড়তে জানেন, নিজের মধ্যে থাকা খচখচ করা উসকানিকে সম্বল করে রাস্তায় দাঁড়াতে জানেন। আর ষড়যন্ত্র, সেটি তো শুধু গন্ধ, সুবিধাবাদীরাই এই গন্ধ ছড়ায়।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]