২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ক্ষুধা, প্রতারণা, আত্মহত্যা কেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ

বগুড়ার ওই যুবক আলমগীর প্রথম শ্রেণিতে পাস করেও দু–তিন বছর ধরে চাকরি পাচ্ছিলেন না
ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ীর ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের ভীষণভাবে বিষাদগ্রস্ত করেছে। এর আগে বগুড়া শহরের এক শিক্ষিত যুবক ‘দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে বিস্মিত করেছেন। ৩ ফেব্রুয়ারি নালিতাবাড়ী উপজেলার এক কৃষক জমির মধ্যে ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

ভারতে গত বছরেই বেশ কয়েকজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। দারিদ্র্যের কারণে ভারত ও বাংলাদেশে মায়ের শিশুসন্তানসহ রেললাইনে ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার একাধিক ঘটনা গত কয়েক বছরে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে মন খারাপ হলেও তা মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, বিবেককে নাড়া দিলে এর প্রতিকারের জন্য প্রতিবাদ করার কথা ছিল।

কার্ল মার্ক্স প্রদত্ত পুঁজিবাদের সংজ্ঞার মধ্যেই ‘শোষণ’ শব্দটি বিদ্যমান। পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকেরাও এ ব্যবস্থায় যে শোষণ হয়—অস্বীকার করেন না, কারণ মার্ক্সের ‘উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব’ গাণিতিক প্রমাণসিদ্ধ। মহসিন খান বারবার উল্লেখ করেছেন তিনি কীভাবে সবার দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। বগুড়ার ওই যুবক প্রথম শ্রেণিতে পাস করেও দু–তিন বছর ধরে চাকরি পাচ্ছেন না কেন? পাচ্ছেন না কারণ তাঁর মামা-চাচাও নেই, ঘুষ দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা। আবার কৃষকও প্রতারিত হয়েছেন আরেক চতুর কৃষক দ্বারা, যিনি বুদ্ধি দিয়ে, অর্থ দিয়ে ইউপি সদস্যের আনুকূল্য লাভ করতে পেরেছেন।

নিঃসঙ্গতা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা হলে কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে। কারও এগিয়ে যাওয়া আর কারও পিছিয়ে পড়া মানে বৈষম্য সৃষ্টি হওয়া। এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা উঁচু শ্রেণিতে উঠে গিয়ে নিচের দিকে আর ফিরে তাকান না। যাঁরা নিচে পড়ে গেলেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁরা আর মেলামেশা করেন না। উঁচুতে ওঠার পরও প্রতিযোগিতা থামে না; বরং আরও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ব্যবধান, আর ব্যবধানই সৃষ্টি করে নিঃসঙ্গতা। আত্মহত্যার আগে মহসিন খান বলছিলেন, ‘নিঃসঙ্গতার যে কি কষ্ট, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বোঝে।’

কবি শামসুর রাহমান একবার এক আন্তর্জাতিক কবিতা সম্মেলনে একটি নিঃসঙ্গতার কবিতা পাঠ করেছিলেন। কবিতাপাঠের আসর শেষ হলে ইউরোপ থেকে আসা এক কবি সে জন্য শামসুর রাহমানকে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোমরা নিঃসঙ্গতার কবিতা লেখো কেন? তোমারা নিঃসঙ্গতার কী জানো? নিঃসঙ্গতার কবিতা লিখব আমরা, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজে বাস করি, একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। তোমাদের কী সুন্দর পারিবারিক বন্ধন, মানুষের মানুষে কী সৌহার্দ্য, কী মেলবন্ধন! তোমাদের কথা ভেবেও সুখ অনুভব করি।’

সমাজতান্ত্রিক দেশে সম্পদ ও উৎপাদনযন্ত্র থাকে রাষ্ট্রের মালিকানায়। সেখানে কোনো প্রতিযোগিতার প্রয়োজন নেই। ব্যক্তিমালিকানাই প্রতিযোগিতার কারণ। কে কত বেশি মুনাফা করতে পারবে, কে কত বেশি সম্পদের মালিক হতে পারবে, তার প্রতিযোগিতা, যা পুরোপুরি অনুপস্থিত সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায়। আবার মুক্তির আনন্দ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিজের মতো করে জীবন পরিচালনার অধিকারও মানুষের সুখের জন্য অপরিহার্য। বস্তুত, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমষ্টির কল্যাণ—এ দুইয়ের মধ্যে বিরাজ করে এক নিষ্ঠুর বৈপরীত্য। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির স্বাধীনতা অসীম হতে পারে না।

সমাজতান্ত্রিক দেশে সম্পদ ও উৎপাদনযন্ত্র থাকে রাষ্ট্রের মালিকানায়। সেখানে কোনো প্রতিযোগিতার প্রয়োজন নেই। ব্যক্তিমালিকানাই প্রতিযোগিতার কারণ। কে কত বেশি মুনাফা করতে পারবে, কে কত বেশি সম্পদের মালিক হতে পারবে, তার প্রতিযোগিতা, যা পুরোপুরি অনুপস্থিত সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায়। আবার মুক্তির আনন্দ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিজের মতো করে জীবন পরিচালনার অধিকারও মানুষের সুখের জন্য অপরিহার্য। বস্তুত, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমষ্টির কল্যাণ—এ দুইয়ের মধ্যে বিরাজ করে এক নিষ্ঠুর বৈপরীত্য। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির স্বাধীনতা অসীম হতে পারে না। সমষ্টির কল্যাণ যাঁর লক্ষ্য, তিনি নিজেই অসীম স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইবেন না। কারণ, তিনি জানেন, সম্পদের সামাজিক মালিকানা ছাড়া সমষ্টির সুখ সর্বাধিক করা যায় না। তিনি জানেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন রাষ্ট্রে যে প্রতিযোগিতা, বৈষম্য আর ব্যবধান, তা মানুষকে নিঃসঙ্গ করে, অসুখী করে, যা মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

সামাজিক বৈষম্য, ব্যবধান, নিঃসঙ্গতা মানুষকে যে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়, পরিসংখ্যানও এর সাক্ষ্য দেয়। দক্ষিণ কোরিয়া একটি ধনী দেশ, কিন্তু ২০১৯ সালের উপাত্ত অনুযায়ী, আত্মহত্যার হার সেখানে সমগ্র পৃথিবীতে চতুর্থ। কারণ, ধনের পাশাপাশি ধনবৈষম্যও সেখানে প্রকট, যা মানুষকে নিঃসঙ্গ করেছে। উত্তর কোরিয়া একটি দরিদ্র দেশ, জীবনে কোনো প্রাচুর্য নেই, বরং জীবনযাত্রার মান খুবই নিম্ন, কিন্তু সেখানে আছে সাম্যের নীতি, নেই ধনী-গরিবের তেমন ব্যবধান। আত্মহত্যার হারও দক্ষিণ কোরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ। এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উত্তর কোরিয়া থেকে যাঁরা পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া গেছেন, তার একটা বড় অংশ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। মেয়েদের মধ্যে অনেকেই পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। বৈষম্যহীন জীবনে অভ্যস্ত তরুণ-তরুণীরা দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তাঁরা জীবনের কাছে হেরে গেছেন।

আরও পড়ুন

আরেক সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবাতেই এই হার দক্ষিণ কোরিয়ার অর্ধেক। অথচ কিউবার জীবন, সাদামাটা জীবন। এই সাদামাটা জীবনেই তারা অনেক ধনী দেশের জনগণের চেয়ে সুখী। কারণ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে একটি যথাযোগ্য কাজের ব্যবস্থাও রাষ্ট্র করে থাকে। অতএব, প্রাচুর্য না থাকলেও দুশ্চিন্তাহীন জীবন তারা যাপন করতে পারে। রাশিয়াতেও সোভিয়েত আমলের চেয়ে বর্তমানের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আত্মহত্যার হার বেড়ে এখন ২৫ দশমিক ১-এ দাঁড়িয়েছে।

একটা কথা এখানে পরিষ্কার হওয়া দরকার, সোভিয়েত ইউনিয়নও কোনো আদর্শ রাষ্ট্র ছিল না, কারণ সেখানেও সমাজতন্ত্রের নীতি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। সোভিয়েত সমাজে মানুষের মধ্যে সমাজতন্ত্রের মূল দর্শন সমন্বিত জীবনচেতনা সঞ্চারিত হয়নি। সমন্বিত জীবনচেতনা তথা স্পিরিট অব কালেকটিভ লাইফ, যা ছাড়া মানুষের সুখ সর্বাধিক করা যায় না। আর সম্পদের সামাজিক মালিকানা ছাড়া সমন্বিত জীবনচেতনা সৃষ্টি হতে পারে না। আবার মানুষের মধ্যে সমন্বিত জীবনচেতনা সৃষ্টি না হলে সম্পদের সামাজিক মালিকানা তারা সমর্থন করবে না। অর্থাৎ দুটি বিষয় একে অন্যের পরিপূরক।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো মুনাফা। কমিউনিস্ট অর্থনীতির চালিকা শক্তি তাহলে কী? এ প্রশ্নে মাও সে তুং একটি উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে আপনার নৌকাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ওপরে উঠে যাবে। একজন মাঝির পক্ষে নিজের নৌকাটি একা একা ওপরে ওঠানো সম্ভব নয়। অতএব, সবাই মিলে নদীর পানি বৃদ্ধি করতে হবে।’ এই উপমার মধ্য দিয়ে তিনি আসলে সমন্বিত জীবনচেতনার কথাই বলছেন।

আরও পড়ুন

সোভিয়েত ইউনিয়নও কোনো আদর্শ রাষ্ট্র ছিল না, সেখানেও সমাজতন্ত্রের নীতি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। কারণ, প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর নিরন্তর বিভিন্ন ধরনের আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছিল। ফলে, সোভিয়েত সরকার হয়ে ওঠে ভীষণ রকম সন্দেহপ্রবণ। বিদেশের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে সন্দেহে অনেক নিরীহ মানুষকে তারা বিনা বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, জেলে পুরেছে।

পৃথিবীজুড়ে কমিউনিস্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে একটি দেশ এককভাবে কমিউনিস্ট হিসেবে টিকে থাকতে পারে না—লেনিনের এ তত্ত্ব অনুসরণ করতে গিয়ে তাদের দেশে দেশে সমাজতন্ত্র ‘পাচার’ করতে হয়েছে, ব্যাপকভাবে অর্থ সাহায্য করতে হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির জন্যও তারা ব্যাপকভাবে অর্থ ঢেলেছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধেও সর্বপ্রকার সহায়তা করেছে তারা, স্বাধীনতার পর আমাদের পুনর্গঠনে অর্থ দিয়েছে, প্রকল্প দাঁড় করে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ কোনো অর্থেই সমাজতন্ত্রের জন্য লড়েনি। পৃথিবীর সব দেশের ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যার ফলে, তার নিজের দেশে জনগণের জীবনযাত্রার মান খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব হয়নি।

ক্ষুধা, প্রতারণা ও আত্মহত্যার মূল কারণ ধনবৈষম্য, মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের উগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতেই হবে। পুঁজির আগ্রাসনে মানবসভ্যতা যে বিপন্ন হবে, তা আশির দশকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। লিখেছিলেন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরে টিউশনি করা জীবনে উচ্চবিত্তের অবহেলায় অতিষ্ঠ হয়ে কবিতা লিখেছিলেন, ‘আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখব বলে’। ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতা উদ্ধৃত করে তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনার কবিতায় এত হতাশা কেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘হতাশা নয়, অভিমান।’ বিচ্ছিন্নতাই মানুষের মধ্যে এই অভিমানের জন্ম দেয়।

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]