শনিবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত টেলিভিশনে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দেখা শেষ করে সবে চোখ বুজেছি, অমনি ফোন। বন্ধুরা ফোন করে জানতে চাইছে খবরটা আমি শুনেছি কি না। সবাই প্রবল উত্তেজিত। জ্যাকসন হাইটসে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় বড় স্ক্রিনে সারা রাত জেগে তারা খেলা দেখেছে, মিষ্টি বিলি হয়েছে। কিন্তু কাছের-দূরের পরিচিত-অপরিচিত সবার সঙ্গে বাংলাদেশের বিজয় গৌরব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে না নেওয়া পর্যন্ত তাদের আনন্দটা পুরো হবে না।
নিউইয়র্কের বাঙালিদের আনন্দের মাত্রা দেখে বুঝতে পারি বাংলাদেশে এই বিজয় কী আনন্দের বন্যা এনে দিয়েছে। এ তো শুধু দুই দলের মধ্যে পাঁচ দিনের এক টেস্ট ক্রিকেট নয়, দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিপক্বতার এক সনদ। পুরো একটা জাতির ভাগ্য যেন আটকে ছিল ওই এগারো জন খেলোয়াড়ের হাতে। দিনের শেষ ২ রান এল দলের সবচেয়ে বয়ঃকনিষ্ঠ খেলোয়াড় মেহেদীর ব্যাট থেকে। বাংলাদেশের ভাগ্য, তা খেলার মাঠেই হোক অথবা বাইরে, এই তরুণদের হাতেই, ঠিক সে কথা ঘোষণা করেই যেন শেষ হলো এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিযোগিতা।
এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ জিতল এই কারণে নয় যে দল হিসেবে তারাই ছিল শ্রেষ্ঠ। তারা জিতল কারণ তাদের ছিল জেতার অদম্য আগ্রহ। সব যুদ্ধেই তারই জিত হয়, যে জেতার জন্য সবকিছু বাজি রাখতে প্রস্তুত। একাত্তরে ঠিক এই কারণেই আমরা জিতেছিলাম। ৪৬ বছর পর, সেই মার্চেই আরেক জয় এল বাংলাদেশের। এ এমন একটা জয়, যা সমগ্র বাংলাদেশকে আবারও এক সূত্রে গাঁথল।
ধর্ম থেকে রাজনীতি ইত্যাদি কত প্রশ্নেই না আমরা দ্বিধাবিভক্ত, কতভাবেই না আমরা নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেরা লড়াই করে শক্তি ক্ষয় করি। অথচ এই কুড়ি-বাইশ বছর বয়সের এই ছেলেগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল জিততে হলে সবার আগে দরকার শক্তির সংহতি ও সম্মিলন। দরকার ব্যক্তির আগে দলকে (এবং দেশকে) স্থান দেওয়া। ব্যক্তিগতভাবে তুমি যতই প্রতিভাবান হও না কেন, তোমার দল যদি না জিততে পারে, তাহলে তুমি বড়জোর ইতিহাসের ফুটনোট। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়েলিংটনে দ্বিতীয় ক্রিকেট টেস্টের কথা ধরুন। প্রথম ইনিংসে রানের বন্যা ছুটিয়ে, জোড়া সেঞ্চুরি করেও বাংলাদেশকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল মাত্র দুই
মাস আগেও।
এর আগেও আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে হড়কে গেছি। একবার নয়, বহুবার। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হলো, তার এক ঘনিষ্ঠ চিত্র পাওয়া গেছে ইএসপিএনের ক্রিকেট ওয়েবসাইট থেকে। গল টেস্টে বিপর্যয়ে দলের সব খেলোয়াড়ই লজ্জিত হয়েছিলেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন দ্বিতীয় ইনিংসে এত সহজে গুটিয়ে যাওয়া ছিল লড়াইয়ের মাঠে গিয়ে লড়াই না করে মাঠ ছাড়ার শামিল।
কলম্বো টেস্টের আগে দলের সব খেলোয়াড় ড্রেসিং রুমে জড়ো হয়েছিলেন একে অপরের সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলতে। সঙ্গে কোচ হাথুরুসিংহে। কোথায় আমরা ভুল করেছি, কী করা উচিত ছিল, এখন কী করা উচিত, তাই নিয়ে আলোচনা হলো। প্রত্যেকে একে অপরের দিকে চোখ তুলে সাদামাটাভাবে নিজেরা যেমন বিশ্বাস করেন, সে কথাটা জানিয়ে দিলেন। দলের সবচেয়ে বর্ষীয়ান খেলোয়াড় থেকে সবচেয়ে নবীন, একে অপরের সঙ্গে নিজের নোট মিলিয়ে নিলেন, ভিডিও দেখে জেনে নিলেন কী কী ভুল তাঁরা করেছিলেন, কোন কোন পরিবর্তন জরুরি। এক ঘণ্টার মিটিং, যখন শেষ হলো সবাই এক নতুন আত্মবিশ্বাসে উচ্চকিত।
মাঠেও দেখা গেল সেই আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ। ঠিক যেসব ছোট ছোট পরিবর্তনের কথা তাঁরা মিটিংয়ে বলেছিলেন, সেসব অর্জনেই তাঁরা মনোনিবেশ করলেন। সবই যে পরিকল্পনামাফিক চলল, তা নয়, কিন্তু বড় ধরনের ভুল হলো না। একজনের পা হড়কে গেলে, অন্যজন তাঁকে সামাল দিলেন। ফিল্ডিংয়ে ভুলের মাত্রা কমল, ব্যাটিংয়ের সময় ঝোড়ো শট নেওয়ার বদলে অধিকাংশই মাথা ঠান্ডা রেখে খেললেন, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বল করার সময় ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা মাথায় রেখে বল করা হলো। অর্জিত হলো জয়।
শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক রঙ্গনা হেরাথ স্বীকার করলেন যোগ্যতর দল হিসেবেই বাংলাদেশ জিতেছে। সাংবাদিকদের তিনি বললেন, উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। আগে অনেকবারই দেখা গেছে চাপের মুখে পড়ে তারা গুটিয়ে গেছে। কিন্তু এই দল অন্য ধাতুতে
গড়া, তারা লড়াই ছাড়া মাঠ ছাড়তে প্রস্তুত নয়। ‘মানতেই হবে তারা এখন যথেষ্ট চালাক।’
খেলার মাঠের যে যুদ্ধ, তার সঙ্গে আমাদের নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন যুদ্ধের খুব বড় রকমের প্রভেদ নেই। রাজনীতি, অর্থনীতি বা বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, তাতে জিততে হলেও চাই ব্যাপক সংহতি ও সম্মিলন। সে জন্যও ড্রেসিং রুমের এক ঘণ্টার ওই মিটিংটা হওয়া খুব জরুরি। এই মিটিংয়ে সবাইকে চাই, কেউ গোসসা করে খিল এঁটে বসে থাকবে না। কেউ বলবে না, আমিই ঠিক, নিজের ‘ন্যাচারাল’ স্ট্রোকের বাইরে আর কিছু বুঝি না। সবাইকে বুঝতে হবে দেশের জন্য জেতাটাই আসল, নিজের ইগো নয়। প্রতিদিনের এই যুদ্ধে জিততে হলে একে অপরের শক্তির পাশাপাশি খামতি মেনে নিয়ে ‘ছোট ছোট পরিবর্তন’ অর্জনে সম্মত হতে হবে।
আমাদের সদ্য যুবা একদল খেলোয়াড় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে যুদ্ধে জেতা যায়। তাঁদের কাছ থেকে জেতার সেই সহজ বুদ্ধিটা যদি আমরা শিখে নিই, ভাবতে পারেন আরও কত যুদ্ধে আমরা জিততে পারি! কলম্বো টেস্টে বাংলাদেশের বিজয় সারা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, আমাদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিভক্তি ভুলে আমরা সমস্বরে এই বিজয়ে কণ্ঠ মিলিয়েছি। আমরা জয়ী হয়েছি বলেই এই আনন্দোৎসব।
একা নিজের ক্ষুদ্র বিজয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে যদি সবাইকে নিয়ে নিজের দেশের জন্য জেতা সম্ভব হয়, তার প্রতিক্রিয়া কী হয়, তার প্রমাণ তো আমরা হাতেনাতেই পেয়ে গেছি।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।