ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক খেলাধুলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ফিলিস্তিনিদের হাতে ইসরায়েলি খেলোয়াড়েরা নিহত হলে খেলার মাঠ হয়ে ওঠে ঘোর রাজনীতির ক্ষেত্র। বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা রাজনৈতিক কারণে বহুকাল আন্তর্জাতিক খেলায় নিষিদ্ধ ছিল। ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে খেলাধুলা ছিল সমাজতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের পরস্পর দ্বন্দ্ব প্রদর্শনীর ক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো মস্কোয় অনুষ্ঠিত ১৯৮০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক বর্জন করেছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার মিত্ররা বর্জন করেছে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ১৯৮৪ সালের অলিম্পিক। ১৯৭২ সালে ববি ফিসার ও বরিস স্প্যাসকির বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধের সমতুল্য একটা কিছু। দুই দেশের ভেতর টান টান উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল এই দাবা খেলাকে কেন্দ্র করে।
তা ছাড়া, শুধু খেলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের ভেতর যুদ্ধের ইতিহাসও আছে। ১৯৬৯ সালে হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের মধ্যে যুদ্ধ বেধেছিল এক ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে, যা ইতিহাসে ‘১০০ ঘণ্টার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ফুটবল উপলক্ষ হলেও এর পেছনে ছিল দুই দেশের ভেতরকার দীর্ঘদিনের বৈরিতা। অ্যাশেজ ক্রিকেট ঐতিহাসিকভাবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার পরস্পর জাতিগত মর্যাদার লড়াইয়ের খেলা। আয়ারল্যান্ড একসময় তাদের দেশে ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি খেলাকে অপরাধ হিসেবেও গণ্য করেছিল। কারণ, এসব খেলার জন্ম ইংল্যান্ডে, যাদের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের ছিল ঐতিহাসিক বিরোধ। মোট কথা আন্তর্জাতিক খেলাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার উপায় নেই। ‘স্পোর্টস ডিপ্লোমেসি’র মাধ্যমে এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে খেলার রাজনৈতিক ব্যবহারও ঘটে থাকে।
দুই দেশের মধ্যে যখন খেলা হয়, তখন দর্শকের জন্য তা স্রেফ একটা আনন্দময় সময় কাটানোর ব্যাপার থাকে না। খেলার একটা প্রতীকী অর্থ দাঁড়ায় তখন। খেলা হয় জাতীয় মর্যাদার প্রতীক। খেলা তখন হয়ে ওঠে প্রতীকী জাতীয়তাবাদ চর্চার আধার। খেলা হয়ে উঠতে পারে একটা জাতির পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ক্রিকেট কী করে উপনিবেশিত একটি জাতির পরিচয় নির্মাণের একটা হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, তার ইশারা আছে ভারতীয় লগান চলচ্চিত্রটিতে। ক্রিকেট বা ফুটবল বিশ্বকাপের সময় দেখতে পাওয়া যায় কী করে খেলা প্রবল দেশপ্রেমের উন্মাদনা তৈরি করতে পারে। তবে খেলাকে কেন্দ্র করে দেশপ্রেম বা উদ্দীপনার জোয়ারেরও একটা দেশীয় চরিত্র আছে।
আমাদের দেশে ক্রিকেট নিয়ে সম্প্রতি সেই উদ্দীপনার জোয়ার আমরা লক্ষ করেছি। বিশেষ করে প্রতিযোগিতা যখন এই উপমহাদেশের দেশগুলোর ভেতর হয়, তখন তা নানাভাবেই এই অঞ্চলের ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। খেলার পেছনে যুক্ত হয় রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব। বাংলাদেশের সঙ্গে যখন পাকিস্তান খেলে তখন এই খেলাকে রাজনীতির বাইরে নেহাত একটা বিনোদন হিসেবে দেখা দুরূহ। কারণ, এই দুই দেশের ভেতর যে ঐতিহাসিক ক্ষতের সম্পর্ক আছে, তা এখনো শুকায়নি।
একসময়ের দুই শত্রু দেশ জার্মানি আর ফ্রান্স এখন খোলামনে ফুটবল খেলে ঠিকই কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, জার্মানিকে এই পর্যায়ে আসতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন তাদের পাপের জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ বহু পদক্ষেপ নিতে হয়েছে দশকের পর দশক ধরে। কিন্তু পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ওপর চালানো তাদের বর্বরতার জন্য ক্ষমা চায়নি বরং এ দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে বারবার। এমনকি দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষেও উদ্ধত সাফাই গেয়েছে। ইতিহাসের ব্যাপারে যাদের ন্যূনতম সংবেদনশীলতা আছে, তাদের পক্ষে খেলার সময় এই সব প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভুলে থাকা অসম্ভব। সে কারণে বাংলাদেশের অনেক মানুষের কাছে পাকিস্তানের ক্রিকেট দল সেই অমীমাংসিত ইতিহাসের প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্যাপ্টেনের ভেতর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের স্বজন মুক্তিযুদ্ধে নিহত কোনো যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেটে জয় তাই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়ের সমান্তরাল হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে মনস্তত্ত্বটি ভিন্ন রকম। মুক্তিযুদ্ধে ভারত ছিল বাংলাদেশের মিত্র। তবে প্রতিবেশী দেশটি শক্তিমান, প্রভাবশালী দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশকে ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে মোকাবিলা করতে হয় নিরন্তর। এই নিয়ে ভারতের সঙ্গে একটা টানাপোড়েনের সম্পর্ক আছে বরাবর। ভারতের সঙ্গে খেলা তাই তাদের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করারই একটা উপলক্ষ হয়ে ওঠে। ভারতকে খেলায় পরাজিত করে জাতীয় জীবনে অন্যত্র তাদের যে আধিপত্যের চাপ রয়েছে, তারই একটা প্রতীকী বদলা নেওয়া হয় যেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশ এখন একটা রাজনৈতিক ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি এ দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবে কি থাকবে না, বাংলাদেশের জাতি-পরিচয়ে ধর্মের অবস্থান কোথায় থাকবে, উন্নয়ন আর গণতন্ত্রের ভেতর কোনটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, বাক্স্বাধীনতার নামে যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীদেরও গণতান্ত্রিক অধিকার বহাল থাকবে কি না—এসব জটিল প্রশ্নের মীমাংসার প্রক্রিয়ার ভেতর আছে দেশ, সেই সঙ্গে দেশে প্রায়ই ঘটছে বীভত্স হত্যাকাণ্ড, অস্বাভাবিক মৃত্যু। এসব মিলিয়ে জনমানুষ মানসিকভাবে ভীষণ একটা চাপে আছে। মাথার ওপর বসে থাকা এই চাপ থেকে মুক্ত হতে চায় সবাই। কিন্তু প্রতিদিনের জীবনসংগ্রাম তাদের সেই মুক্তির পথ বিশেষ রাখে না। বিভিন্ন বার্ষিক উৎসব, পার্বণের বাইরে জাতির জীবনে সম্মিলিতভাবে আনন্দ করার উপলক্ষ বিশেষ আসে না। সেখানে ক্রিকেট হঠাৎ হঠাৎ একটা চমৎকার জানালা হিসেবে দেখা দেয়, যেখান দিয়ে মুক্ত বাতাস আসতে পারে।
ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় যাবতীয় উদ্বেগ, লড়াই খানিক সময়ের জন্য বাক্সবন্দী করে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে একটা নকল লড়াইয়ে সবাই মিলে যোগ দেওয়া যায়। খেলার সেই কয়েকটা ঘণ্টা মনে হয় ওই ক্রিকেট পিচের বাইরে সমাজ-সংসার সবই যেন মিথ্যা। এক আশ্চর্য ঘোরে বুঁদ হয়ে থাকে সবাই। এই ঘোর প্রতিদিনকার অনেক কষ্টকে লাঘব করে। আর খেলায় যদি একটা জয় পাওয়া যায়, তখন বিশ্ব দরবারে অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের যত সব পরাজয়, গ্লানি সব যেন ধুয়ে যায় মুহূর্তে। আমরা জাতিগতভাবে চাঙা হয়ে উঠি। তা দেশের ভেতরে থাকা বা প্রবাসী উভয় বাংলাদেশিদের জন্যই সমান সত্য। কেন জাতীয় ক্রিকেট লোগো ব্যক্তিগত প্রোফাইলে লাগিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ফেসবুকে বিশ্ব রেকর্ড করে বসে, সেটা বাইরের মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। ক্রিকেটকে নিয়ে বাংলাদেশের এই আবেগ বুঝতে এ দেশের কাদামাটির সঙ্গে নাড়ির একটা যোগ থাকতে হবে।
স্পষ্টতই বাংলাদেশের ক্রিকেট বিনোদনের ঊর্ধ্বে জাতীয় পরিচয়ের একটা উপাদান হয়ে উঠেছে এখন। তবে একটা খেলাকে যদি পুরো জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার ভার বহনের দায়িত্ব নিতে হয়, তাহলে তার ঝুঁকিও থাকে অনেক। এতে করে খেলোয়াড়দের ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি হয়। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলে এই জনগোষ্ঠীই যে খেলোয়াড়কে বীর বলে বরণ করেছে, তাঁকে মুহূর্তে ধুলায় মিশিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না। ক্রিকেটারদের তেমন অপমানের অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক। খেলাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদ উগ্র, লাগামহীন হয়ে উঠতে পারে। সব মিলিয়ে ক্রিকেট এবং রাজনীতি একে অন্যের সঙ্গে মিশে থাকবার একটা পর্ব চলছে বাংলাদেশে। আমাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর যখন নিষ্পত্তি ঘটবে, ক্রিকেটের বাইরে অন্যান্য খেলাও যখন দেশে সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তখনই হয়তো ক্রিকেট শুধুই একটা বিনোদনের ব্যাপার হবে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক
[email protected]