১০ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে একটি মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়েছিলাম। মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আয়োজিত সেই সভায় সাবেক কূটনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের কয়েকজন অধ্যাপক এবং আমার মতো নাগরিক সমাজের সদস্যসহ ২০-২৫ জন উপস্থিত ছিলেন। প্রধান বক্তা ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সময়ের চিন্তাধারা ও পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করার চিন্তাভাবনা করা হয়েছে, সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেন। তিনি জানালেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখনো বঙ্গবন্ধুর ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতির ধারাবাহিকতাই রক্ষা করে চলেছে।
বর্তমান ও আগামী দশকে বাংলাদেশের সামনে মোটাদাগে যে চ্যালেঞ্জগুলো বর্তমান, সভায় সেসব নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা হয়। আমার মতে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো: ১. রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা এবং মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, ২. ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোট বা কোয়াড এবং ৩. বাংলাদেশের ‘পূর্ব নীতির’ ভবিষ্যৎ।
এই আলোচনা যখন চলছিল, বোধ করি ওই সময়ই অথবা এর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ঢাকায় কূটনৈতিক সাংবাদিকদের এক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঢাকা কোয়াড বা আইপিএসে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষতি হবে। এই উক্তির প্রতিক্রিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন পরে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, এ ধরনের বক্তব্য দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ওপর হস্তক্ষেপ। স্বাধীন বাংলাদেশের নীতি স্বাধীনভাবে রচিত।
চীনের রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে পরে অবশ্য বলা হয়, তিনি ভাষা প্রয়োগে ভুল করেছেন। তবে মূল বক্তব্য কিন্তু তিনি প্রত্যাহার করেননি। চীনের স্টেট কাউন্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর উপস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং এ বিষয়ে একটি বক্তব্য দেন। সেখানেও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার কথাটি উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য প্রত্যাহার বা প্রত্যাখ্যানের মতো কিছু ছিল না। মোদ্দা কথা, সবুজসংকেত না পেয়ে চীনের রাষ্ট্রদূতেরা সাধারণত কোনো বিষয়ে মন্তব্য করেন না।
যাহোক, চীনবিরোধী বলে পরিচিত সামরিক জোট ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোট বা কোয়াড সম্পর্কে অল্পবিস্তর খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন, এই মুহূর্তে চার জাতির এ জোটে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ ভারত। এই অঞ্চলের অন্য কোনো দেশ এখন পর্যন্ত এতে যুক্ত হয়নি। কোয়াডে ভারতের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীনের পরই ভারতের নৌ ও সামরিক শক্তি স্বীকৃত। যদিও ভারত মহাসাগরের সম্পূর্ণ অঞ্চল প্রভাবিত করার মতো শক্তির পরীক্ষা এখনো হয়নি। এই জোটের আর তিন সদস্য অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। মূল শক্তি যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় প্রথম থেকেই কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই মার্কিনরা চীনের কমিউনিস্ট মতবাদ ও বর্তমান উদীয়মান চীনা শক্তির বিরোধিতা করে আসছে।
অন্যদিকে উত্তরে ভারতের একমাত্র প্রতিবেশী চীন। তাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও কমিউনিস্ট সরকারের প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯৪৮) থেকেই তিব্বত ও কমিউনিস্টবিরোধী মনোভাবের কারণে ভূকৌশলগত সম্পর্কে টানাপোড়েন বিদ্যমান। ১৯৬২-এর চীন-ভারত যুদ্ধের পর নেহরু রচিত ‘পঞ্চশীল’ নীতি ভেঙে পড়ে। চীনের তিব্বত দখল এবং ভারতে দালাই লামার আশ্রয় গ্রহণের পর থেকেই সমস্যা সংকটের পর্যায়ে চলে যায়। ইদানীং চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটেছে। ২০২০ সালের মে মাসে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় নিয়ন্ত্রিত সীমান্তে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর তা বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিগোচর হয়। গালওয়ান উপত্যকা এবং চীন-ভারত সীমান্তের উত্তেজনা আপাতত শান্ত।
১৯৯১ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারি গড়ে তুলেছে ভারত। যার জেরে ইতিমধ্যে তারা সীমিত পরিমাণ সমরাস্ত্র থেকে সম্মিলিত সামরিক অনুশীলনেও যুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ‘মালাবার’ নামের ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকেন্দ্রিক নৌ মহড়া এবং বিমানবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ মহড়ার কথা বলা যায়। বহুদিন থেকেই পাকিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকে কোয়াডে সহযোগী করার প্রয়াস চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। বাদবাকি দেশগুলোতে চীনের প্রভাব খর্ব করার কূটনৈতিক প্রয়াসও দৃশ্যমান। অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক নৈকট্যের কারণে ভারত মহাসাগরীয় বঙ্গোপসাগর তটের দেশ বাংলাদেশ অবশ্যই কোয়াড সদস্যদের কাছে, বিশেষ করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য দেশের মধ্যে চীনসংলগ্ন নেপাল ভারত থেকে অনেকটাই দূরে সরে চীনের প্রভাববলয়ে রয়েছে।
এখন পর্যন্ত চারটি দেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশই কথিত ‘পূর্ব ন্যাটো’ বলে কথিত সামরিক উদ্যোগে যোগ দেয়নি। সরাসরি ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি। এমনকি সিঙ্গাপুরও এ বিষয়ে এখনো কোনো সাড়া দেয়নি। যদিও ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার কোয়াডে যোগদানের গুঞ্জন রয়েছে।
যদিও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক, বিশেষ করে অনেক ভারতীয় সামরিক বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশের নৌবাহিনী তথা সামরিক বাহিনী কোয়াডে যোগ দিলেও কোনো কার্যকর সহযোগিতা করতে পারবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া কোয়াডে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কেউ অর্থনৈতিকভাবে বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করতে পারে, এমনও নয়। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়। এখনো বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগী দেশ হিসেবে জাপান এগিয়ে। তবে দ্রুতই এই ফারাক কমিয়ে আনছে চীন। জাপান বা চীনের তুলনায় ভারত অর্থনৈতিকভাবে বেশ দুর্বল, বিশেষ করে কোভিড মহামারির কারণে ভারতের অর্থনীতির চাকা ভেঙে পড়েছে।
এত কিছুর পরও বিগত ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ দিকে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান হয়েছিল। তৎকালীন ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট স্টিফেন বেইগান ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছিলেন এবং পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে অনেকটাই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সে চাপ মনে হয় এখনো অব্যাহত আছে। অন্যদিকে এ বছরের প্রথম দিকে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের বাংলাদেশ সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, এখানেও কোয়াডই ছিল মুখ্য। ধারণা করা হয়, এই তৎপরতার প্রেক্ষাপটে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিন উইফেং গত মাসে ঝটিকা সফর করে রাষ্ট্রপতির কাছে কোয়াড প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। মনে করা হয়, এরই জের ধরে চীনের তরফ থেকে রাষ্ট্রদূতের এমন উক্তি। বাংলাদেশ যদি কোয়াডে যোগ না–ও দেয়, তারপরও চীন যাতে কোনোভাবে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের তটে তৎপরতা বাড়াতে এবং বন্দর ব্যবহার না করতে পারে, তার জন্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের এই সম্মিলিত প্রয়াস। অন্যদিকে চীন দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কোভিড টিকার জরুরি মজুতের যে প্ল্যাটফর্ম তৈরির ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশকে রাখতে আগ্রহী। অবশ্য তা বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো তেমন কোনো আলোচনা শোনা যাচ্ছে না।
যাহোক, কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অঙ্গনে কোয়াড চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে সমান দূরত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যতেও সর্বতোভাবে এটা অব্যাহত রাখাটাই হবে আগামী বাংলাদেশের জন্য শ্রেয়।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)