কোটাব্যবস্থা যেমন হওয়া উচিত
সারা পৃথিবীতে সরকারি চাকরিতে কোটা রাখা হয় বৈষম্যের প্রতিকার করার জন্য। অথচ এই দেশে কোটার ব্যবস্থাপনা বৈষম্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান সরকারি চাকরিতে কোটা ও মেধার অনুপাত ৫৬ বনাম ৪৪ শতাংশ। কোটার বরাদ্দ যথাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পোষ্যদের ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, আদিবাসী ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। ফলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ পান মাত্র ৪৪ শতাংশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, ‘পৃথিবীর এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোটা মেধাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। আমরা পারছি। অর্থাৎ উল্টো যাত্রায় আমরাই প্রথম।’
আমরা দেখলাম কোটা সংস্কার আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। এই দাবির সপক্ষে সাধারণ ছাত্রজনতা রাজপথেও নেমে এসেছে। তবে এই দাবি নিয়ে আগানোর পথে আমাদের অবশ্যই একটি পরিবর্তনের রূপরেখা নিয়ে আগাতে হবে। বর্তমান কোটাবিন্যাসের ঠিক কেমন পরিবর্তন আমরা চাই, সেটি আমাদের পরিষ্কার করে জানাতে হবে। নামকাওয়াস্তে সংস্কার যেমন আমরা মেনে নিতে পারি না, তেমনি সকল কোটা বাতিলের যে কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। পরিষ্কার এবং শক্তিশালী সংস্কার আমাদের প্রয়োজন।
সবার প্রথমেই যে কোটার সবচেয়ে বড় সংস্কারের কথা বারবার বলা হয়েছে, সেটি হলো মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এমনকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটার শতকরা হার কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে খোদ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। কমিশন মনে করে, সরকারি সার্ভিসের গতিশীলতা আনতে, কোটাপদ্ধতি ও কোটাবিন্যাস পদ্ধতির পুনর্বিবেচনা ও পুনঃপর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ১০০ ভাগের ৩০ ভাগ বরাদ্দ নিঃসন্দেহে অনেক বেশি, তবে সেটিই মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে একমাত্র চিন্তার বিষয় নয়। এর বাইরেও রয়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা লুটতে চাওয়া ক্ষমতাবান গোষ্ঠীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। ১৯৮৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩, অথচ বর্তমান সরকারের প্রথম দিকের একটি তালিকায় ২ লাখ ২ হাজার ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়। তাঁদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন—এই মর্মে আপত্তি দাখিল হয় ৬২ হাজার। এইভাবে কোটার লোভে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে তালিকা ভরানো কেবল দুঃসহনীয় একটি দুর্নীতিই নয়, বরং আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চরম অবমাননাও বটে।
যেকোনো কোটার ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানের দুর্নীতির উপায় থেকে যায়। যেহেতু পিএসসির মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডগুলো সাধারণত একজন পিএসসি সদস্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এবং যেহেতু পিএসসি সদস্য হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়স্বজন নিয়োগপ্রাপ্ত হন, কাজেই তাঁরা যে মৌখিক পরীক্ষায় সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবেন, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন। এমতাবস্থায় যদি মৌখিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোটার হিসেবে ক্ষমতাবানদের দাপট টিকে থাকে, তাহলে সাধারণ ক্ষমতাহীন মেধাবী ছাত্রদের জনপ্রশাসনে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে আসে। আয়ের হিসাবে কোটার হিসাব হলে এই কোটা নিয়ে দুর্নীতি করার সুযোগটি কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়ে আসে।
আয়ের হিসাব ব্যতীত দ্বিতীয় যে হিসাবটি মাথায় রাখতে হবে, সেটি হলো বেসরকারি খাতে বৈষম্যের পরিমাপ। যদি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সামাজিক দীনতার কারণে বেসরকারি খাতে চাকরি পেতে অথবা স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করতে নির্দিষ্ট কিছু বাধার সম্মুখীন হয়, তবে তাদের জন্য কোটার সুবিধা রাখা যেতে পারে। এমন কাঠামোগতভাবে বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন নারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী, প্রতিবন্ধী এবং প্রত্যন্ত জেলার বাসিন্দারা, যারা সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার থেকে বঞ্চিত হন। তাঁদের জন্য ৪ শতাংশ করে মোট ১৬ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রেখে দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য ৪ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হলে বর্তমান কোটাব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি গণমুখী এবং কার্যকরী একটি বিন্যাসের দিকে আমরা আগাতে পারব।
আয়ের হিসাব দিয়ে দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্তদের হিসাব করলে এমন বিন্যাসটিই এসব জনগোষ্ঠীর জন্য যথেষ্ট হওয়ার কথা। নিজেদের হিসাব অনুযায়ী সরকার এর মাঝে চাইলে কমবেশি করতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই সব মিলিয়ে মোট কোটার পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি রাখা সমীচীন হবে না। কোটার বাইরে থাকা উচ্চবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্ত তরুণেরা সরকারি চাকরি চাইলে অবশ্যই করতে পারবে, তবে তাদের মেধার লড়াইয়ে টিকে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে।
কোটাব্যবস্থার সংস্কার এখন সময়ের দাবি। দেশের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে আজ বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয় (নট ইন এমপ্লয়মেন্ট, এডুকেশন অর ট্রেনিং)। জাতিসংঘঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন করতে হলে আমাদের এই হার কমিয়ে আনতে হবে। কোটাব্যবস্থার সংস্কার হতে পারে সেই লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলি খান রেগুলেটরি কমিশনের প্রধান হিসেবে ২০০৮ সালের মার্চ মাসে কোটাব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন। এতে বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৪ জনকে নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়। যে বৈষম্যহীন সোনার বাংলা গড়ার জন্য একাত্তর সালে ৩০ লাখ শহীদ জীবন দিয়েছেন, বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসা কোটাব্যবস্থার জালে পড়ে তার আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। এই দুরবস্থার থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের এমনভাবে কোটাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করতে হবে, যাতে করে সরকারি বৈষম্যের হাতিয়ার না হয়ে বেসরকারি বৈষম্যের প্রতিকার হয়ে ওঠে কোটা। আয়ের হিসাব, বৈষম্যের হিসাব আর সীমিত শতকরার হিসাবই সেটি করবার জন্য সর্বোত্তম উপায়।
অনুপম দেবাশীষ রায়, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াশিংটন ডিসি।