রাষ্ট্রের আঙিনায় আরও এক শিক্ষকের ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী। বাসা থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে সংস্কৃতিমনা, ধীমান এই শিক্ষককে খুন করা হয়েছে ২২ এপ্রিল সকালে। সামাজিক মাধ্যমে যে ছবি পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে পরিষ্কার দেখছি আমরা রক্তস্তূপের মধ্যে পরিপাটি এক শিক্ষকের উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহ। পাশে ব্যাগ, পায়ে স্যান্ডেল জুতো তখনো অক্ষত।
কোনো উচ্চকিত রাজনৈতিক বক্তব্য তিনি দেননি কোনো দিন—সাক্ষ্য দিচ্ছেন তাঁর সহকর্মী, শিক্ষার্থী কিংবা যাঁরা তাঁকে চেনেন। পিএইচডি করেছেন কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের কবিতা নিয়ে। বাজাতেন সেতার। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি নয়; বরং পড়াশোনা, শিক্ষার্থীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক সৌভিক রেজার ফেসবুক নোটে পড়লাম, অধ্যাপক সিদ্দিকীর সঙ্গে তাঁর যতবার দেখা হয়েছে, তা মূলত লাইব্রেরিতে। সাহিত্যের যে ছোট কাগজটি সম্পাদনা করতেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভাগে, সেটির নাম কোমলগান্ধার। মনে করিয়ে দেয় আরেক বেদনার নাম। ঋত্বিক ঘটক। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণে দেশভাগের বেদনা থেকে যিনি কোনো দিন নিজেকে বিযুক্ত করতে পারেননি। যে সাংস্কৃতিক সংগঠনটির উপদেষ্টা ছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকী, সেই সংগঠনের নাম ‘সুন্দরম’। নিজ গ্রাম বাগমারায় প্রতিষ্ঠা করেছেন গানের স্কুল। ক্লাসে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প থেকে উদাহরণ টানতেন বলে জানিয়েছেন তাঁর শিক্ষার্থীরা।
পণ্য হয়ে যাওয়া শিক্ষকতাকালে তিনি জীবন চালিয়েছেন কেবলই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনে, তাই চাকচিক্য ছিল না জীবনযাপনে। অথচ শিক্ষার্থীদের বিভাগেই ভালো চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের টাকায় কিনেছেন প্রজেক্টর। নিজে লিখতেন চলচ্চিত্র বিষয়ে। সুন্দরম-এর অনুষ্ঠানের ছবি তোলার জন্য নিজের টাকায় কিনেছেন ক্যামেরা। বিভাগের বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন হতো তাঁর উদ্যোগে। আর যেতেন খেলার মাঠে বিভাগের ছেলেমেয়েরা খেলতে গেলে, যখন তাঁরা নিশ্চিত হারবেন জানতেন, তখনো। এই ওপর-চালাকির যুগে এমন একজন নির্লোভ মানুষের যে নাম হওয়ার কথা, তাঁর নামও তাই হয়েছিল শিক্ষার্থীদের কাছে ‘ম্যাড স্যার’। ডাকটা আদরের।
একজন আদর্শবাদী, শিক্ষার্থীবান্ধব, সংস্কৃতিমনস্ক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের এহেন খুনে দেশটাতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগার কথা। সেই ঝাঁকুনিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকার, সব রাজনৈতিক দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচণ্ড অভিঘাত হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের বিবৃতি চোখে পড়েনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনো প্রতিবাদ হয়নি। ২৪ এপ্রিল কিছু বামপন্থী ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে ‘রেজাউল করিম হত্যার বিচারপ্রার্থী নাগরিকবৃন্দ’ নামে শাহবাগে একটি প্রতিবাদী সমাবেশ হয়েছে। হাতে গোনা কিছু মানুষ এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন বহুদিন থেকে। তাঁদের সংখ্যাও প্রতিটি মৃত্যু এবং হুমকির পরে কমে যাচ্ছে। অনেকেই ভয় পেয়েছেন কাছের সহযোদ্ধাদের নির্মম মৃত্যুতে। দেশ ছেড়েছেন অনেকেই হুমকির মুখে। আরও অনেকে ছাড়ার প্রতীক্ষায়।
কোথাও কোনো কান্না নেই। ভয় আছে কেবল। প্রত্যেকেই শঙ্কিত নিজের জীবন নিয়ে। এ-জাতীয় ধারাবাহিক খুনের পরে, সেই সব খুনের কোনো কিনারা না হওয়ার কারণে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক রাষ্ট্রের বিচারহীনতার প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা জ্ঞাপন করে বলেছিলেন, পুত্র হত্যার বিচার তিনি চান না। তারপর নিহত অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী একই কথা বলেন। এই অনাস্থায় সরকারের কোনো বিকার দেখিনি।
অথচ বিচার তাঁরা চাইছেন না, চেয়ে লাভ নেই বলেই। যেহেতু অধ্যাপক সিদ্দিকী কোনো রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা নন, ব্লগার নন, ধর্ম বিষয়ে তাঁর কোনো ব্লগ আবিষ্কার করা যায়নি, তাই প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটানোর পরে সবাই বোঝার চেষ্টা করছেন এই হত্যাকাণ্ড কেন হলো। পুলিশের প্রাথমিক ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ‘সংস্কৃতিকর্মী’, তাই হয়তো কেউ তাঁকে খুন করে থাকবে। অনেকেই পুলিশের এই ভাষ্যে হাসলেও আমি এ কথাকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছি। তাঁর সঙ্গে কারও কোনো শত্রুতার কথা তাঁর পরিবার জানে না। তাহলে, তাঁর দোষের মধ্যে রইল রবীন্দ্রচর্চা, সেতারবাদন, কোমলগান্ধার আর ‘সুন্দরম’-এর সঙ্গে সম্পর্ক, গানের স্কুল বানানো। কী ভীষণ সব অপরাধ! যে দেশে ওলামা লীগ স্কুল-পাঠ্যবই থেকে অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার জন্য বিনা বাধায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে, সেই দেশে রবীন্দ্রচর্চা, সেতার বাজানো, বাংলা ভাইয়ের বাগমারা গ্রামে গানের স্কুল বানানো—এসব অপরাধ বৈকি! এসব বিষয়কে অপরাধ গণ্য করে খুন করার অবস্থায় এক দিনে আসেনি দেশ।
গত ১২ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন অধ্যাপক খুন হয়েছেন। ২০০৪ সালে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসের হত্যাকারীদের বিচারিক আদালতে ফাঁসির আদেশ হলেও, পরবর্তী ধাপে এ বছর ২৪
ফেব্রুয়ারি আসামিদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। ২০০৬ সালে খুন হওয়া ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তাহের আহমেদের মামলার অন্যতম মূল আসামি সালেহীন ‘বেনিফিট অব ডাউট’-এর সুবিধা নিয়ে বেকসুর খালাস হয়েছেন।
২০১৪ সালে অধ্যাপক শফিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত কারণ বলা হলো। ব্যক্তিগত কারণে কাউকে হত্যা করা হলেও হত্যাকারীরা তো খুনিই বটে! সেসব হত্যাকারীর বিচারের কী ব্যবস্থা হলো? ২০১৫ সালে ব্লগার খুন হলেন চারজন, একজন প্রকাশক। এ মাসেই খুন হলেন আরেক ব্লগার নাজিমউদ্দিন। কিনারাহীন তদন্ত-প্রক্রিয়ার মধ্যে ক্ষমতার শীর্ষ মহল থেকে বলা হলো ‘ধর্মবিরোধী’ কোনো লেখার কারণে হত্যাকাণ্ডের দায় রাষ্ট্র নেবে না। ‘ধর্মবিরোধী’ শব্দবন্ধটি এতই ব্যাপক যে কোন আচরণকে ধর্মবিরোধী বলা হবে, সেই সংজ্ঞা কে নির্ধারণ করবে? সেতার বাজানো, রবীন্দ্রচর্চা, গানের স্কুল বানানো, চলচ্চিত্র দেখা—এসব কি ধর্মবিরোধী?
আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে দেখলাম পত্রিকায়। তাদের সংবাদসংস্থা ‘আমাক’ এর ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে:
‘বাংলাদেশের রাজশাহী শহরে দাওলাতুল ইসলামের সৈনিকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে হত্যা করেন, সে নাস্তিকতাবাদের দিকে লোকদের আহ্বান করত।’ (http://i.imgur.com/juRSA5X.jpg তাঁর সংস্কৃতিচর্চাই কি তবে ‘নাস্তিকতাবাদের দিকে লোকদের আহ্বান করা?’
জানা কথা যে এই হত্যাকাণ্ডের অন্তহীন তদন্ত শুরু হবে এবং এই নির্বিবাদী শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডকে হয় ব্যক্তিগত কারণে বলে চালিয়ে দেওয়া হবে অথবা ধামাচাপা পড়বে। ফের রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখব অন্য কোনো শিক্ষক, লেখক বা শিল্পীকে। অব্যাহত খুন দেখতে দেখতে এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের আর আলোড়িত করে না। ব্লগার, প্রকাশক হত্যাকাণ্ডের পর চাপাতি কিন্তু ধাবমান হয়েছে শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মীদের দিকে। এ যে একাত্তরের মতোই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের আরেক নীলনকশা—সরকার ভোটের রাজনীতির কথা চিন্তা করে এই সত্যকে উপেক্ষা করে চলেছে।
তবে আমি সবচেয়ে বেশি বিচলিত এমন হত্যাকাণ্ডের পরেও দেশ নিস্তরঙ্গ বলে। অব্যাহত খুনকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি ক্ষমতাবান রাজনীতি তৈরি করেছে বটে, কিন্তু এই অন্যায় বুমেরাং হতে বাধ্য। সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু আমরা কোথায় যাব মেনে নিতে নিতে? নাজিমউদ্দিনের হত্যাকাণ্ডের সময় আমি International Sunbelt Social Network Conference 2016-এ যোগ দেওয়ার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে ছিলাম। এবার জর্জ সিমেল পুরস্কার পেয়েছেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্যারি রবিনস। তিনি তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তি বক্তৃতা করেছেন যোগাযোগের বহুতল বিশ্লেষণের ওপর। দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে কিছু যুদ্ধংদেহী বিশ্বনেতা, সেই সব রাষ্ট্রের সমর কোম্পানি এবং ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব অভিলাষী সাধারণ মানুষ—এই তিন স্তরের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংঘটিত হতে পেরেছে। সেই থেকে আমি ভাবছি, ঠিক কত স্তরের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসব হত্যাকাণ্ড নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে চলেছে।
বিচার না চাওয়াটা সমাধান নয়। দীর্ঘদিন অস্বস্তিতে আছি, বেদনায় আছি, ক্ষুব্ধতায় আছি। সহজে স্বস্তি দিতে রাজি নই এসব খুনের দিকে চোখ বন্ধ করে রাখা সরকার এবং রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র এসব হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না। একজন প্রকৃত শিক্ষকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইছি রাষ্ট্রের কাছে। আমাদের অব্যাহত সম্মিলিত প্রতিবাদ রাষ্ট্রকে এসব হত্যাকাণ্ড বিষয়ে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করুক।
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।