২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

কেরালায় কেন অক্সিজেন–সংকট নেই

নিজের চাহিদা মিটিয়েও অন্তত তিনটি রাজ্যকে এখন নিয়মিত অক্সিজেন দিচ্ছে কেরালা।

ভারতে প্রতিদিন ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর বিশ্ব রেকর্ড হচ্ছে। দেশটিতে যে অক্সিজেনের তীব্র সংকট চলছে, সেটাও এখন আন্তর্জাতিক বড় খবর।

ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে কেবল কেরালায় কোনো অক্সিজেন–সংকট নেই। শুধু তা–ই নয়, এ মুহূর্তে তাদের অক্সিজেন মজুত আছে ৫০০ থেকে ৬০০ টন। বাকি ভারত যখন অক্সিজেনের জন্য হাহাকার করছে, তখন শুধু কেরালায় কেন অক্সিজেন–সংকট নেই, ভবিষ্যতের স্বার্থেই সেটা জানা জরুরি। বাংলাদেশের জন্যও ‘কেরালা মডেল’কে বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ।

মাত্র দুই বছর আগেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। পাশের রাজ্যগুলো থেকে তখন অক্সিজেন আনতে হতো। করোনা সংকট এ অবস্থা পাল্টে দিয়েছে।

অনেক দেশের চেয়ে কেরালায় অক্সিজেন উৎপাদনকেন্দ্র বেশি
আয়তনের দিক থেকে কেরালা ভারতের ২২তম রাজ্য। এখানে থাকে ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ। কিন্তু নাগরিক নিরাপত্তার জন্য যা কিছু জরুরি, তার অনেক কিছুতেই বরাবর এগিয়ে এই ছোট রাজ্য। এক দশক ধরে পুরো ভারত যখন তথাকথিত ‘গুজরাট অর্থনৈতিক মডেল’-এ মাতোয়ারা, তখন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতে প্রকৃত অগ্রগতি ঘটিয়ে চলেছে কেরালা। তারই বড় নজির এই অক্সিজেন উদ্বৃত্ত থাকার ঘটনা। এই রাজ্যে এখন গড়ে দিনে অক্সিজেন লাগছে ৮০ থেকে ১০০ মেট্রিক টন। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা আছে ২০০ মেট্রিক টনের বেশি। ভারতের ছোট এই রাজ্যে অক্সিজেন উৎপাদনের পাঁচটি কেন্দ্র রয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের সামর্থ্যের চেয়েও যা বেশি।

সামান্য কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপ তাদের আজকের নিরাপদ অবস্থা নিশ্চিত করেছে। গত বছর মার্চে যখন মহামারির শুরু হয়, তখন থেকেই এ রাজ্যে অক্সিজেনের সম্ভাব্য চাহিদা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত নজরদারি ছিল। মহামারির পরের ঢেউগুলোয় সংকটের চেহারা কেমন হবে, সেটা আগেই জরিপ করে রেখেছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ। কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করেই কেরালার স্বাস্থ্য বিভাগ নজরদারির এই কাজ করে। শুধু ওই সব সংস্থায় স্থানীয়ভাবে বাছাই করা কিছু জনবল বসিয়ে দিয়েছিল তারা।

গত বছরের মার্চ থেকেই কেরালা অক্সিজেন উৎপাদনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করে। কোনো একটা উৎপাদনকেন্দ্রে সমস্যা হলেও যাতে বিকল্প থাকে এবং কোনো ধরনের ‘মনোপলি’ তৈরি না হয়, তার জন্যই এ ব্যবস্থা। পাশাপাশি শিল্প খাতের অক্সিজেনের বদলে হাসপাতালের অক্সিজেন উৎপাদনে বিশেষ মনোযোগ দেয়। কোভিডের সময় কেরালা প্রশাসনের চিন্তা কেবল শিল্প ও অর্থনীতিকে ঘিরে ছিল না; সরকারের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল স্বাস্থ্য খাত।

মনোপলি ঠেকাতে নতুন উৎপাদনকেন্দ্র
কমিউনিস্টশাসিত রাজ্য কেরালা। কিন্তু সেখানে বেসরকারি খাতে দিব্যি বিপুল অক্সিজেন উৎপাদন করা হচ্ছে। রাজ্য সরকার শুধু চাহিদা, উৎপাদন ও সরবরাহে কঠোর নজরদারি করছে। মনোপলি কমিয়ে আনতে অক্টোবরে রাজ্যে নতুন আরেকটা অক্সিজেন উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। ফল হয়েছে এই যে গত বছর এপ্রিলেও যেখানে অক্সিজেন উৎপাদন হতো ৯৯ মেট্রিক টন, সেখানে চলতি এপ্রিলে হচ্ছে ২১৯ মেট্রিক টন।

কেরালা যেহেতু অবিজেপিশাসিত রাজ্য, তাই তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল বরাদ্দেও রক্ষণশীলতা আছে। এ অবস্থা সামলাতে রাজ্য সরকার কিছু কিছু হাসপাতালকে জনতার কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে মেডিকেল বেডগুলোর সঙ্গে অক্সিজেন পাইপলাইন সংযোগ করে নিতে বলে। কিছু হাসপাতাল কাজটি করতে পেরেছিল। এতে অক্সিজেন পরিবহন ঝামেলা অনেক কমে যায়। এ রকম নানা পদক্ষেপের সূত্রেই এখন নিজের চাহিদা মিটিয়েও অন্তত তিনটি রাজ্যকে নিয়মিত অক্সিজেন দিচ্ছে কেরালা।

টিকায় অপচয়শূন্য রাজ্য
ভ্যাকসিনেশনেও দৃষ্টান্ত গড়েছে কেরালা। ভারতজুড়ে টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। মূলত, প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীর ঘাটতির কারণে এই অপচয় হচ্ছে। হিসাব করে দেখা গেছে, যে অপচয় হয়েছে, তাতে দু–একটি রাজ্যের সবাইকে টিকা দেওয়া যেত। কেরালা, পশ্চিমবঙ্গসহ অল্প কিছু রাজ্যে টিকার অপচয় কম। কেরালায় সেটা প্রায় শূন্য। কেরালার এই সফলতার কারণ হলো অতীতে রাজ্যে নানা ধরনের টিকাদান কর্মসূচির কারণে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি ছিল।

ভ্যাকসিনের জন্য গণচাঁদা
ভারতে টিকা বণ্টনে কোটা আছে। টিকা উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ব্যবধানও আছে। নতুন নীতিমালায় কেন্দ্র বলেছে, রাজ্যগুলো চাইলে টিকা কিনেও ব্যবস্থা করতে পারবে। দেশের টিকা উৎপাদকেরা অর্ধেক পণ্য খোলা বাজারে ছাড়বে। বিশেষ করে ৪৫-এর কম বয়সীদের বাজার থেকে কেনা টিকাই দিতে হবে। কিন্তু কেরালা সরকার বলছে, সবাইকে তারা বিনা মূল্যেই টিকা দিতে চায়। যদি এটা করতে হয়, তাহলে এই রাজ্যের অন্তত ১ হাজার ৩০০ কোটি রুপি দরকার। টিকা কর্মসূচি চালু রাখতে তাই গণচাঁদা কর্মসুচির ডাক দিয়েছে কেরালা সরকার। ভারতে শুধু তারাই অভিনব এ উদ্যোগ নিয়েছে। কেরালার প্রচুর মানুষ বিদেশে থাকে। গণচাঁদার ডাকে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে তারা। ঘোষণার প্রথম দুই দিনে প্রায় দুই কোটি রুপি মুখ্যমন্ত্রীর তহবিলে জমা দিয়েছে দেশ-বিদেশে থাকা এই রাজ্যের মানুষ। এভাবে পাওয়া অর্থ দিয়ে বাজার থেকে টিকা কিনে ভাইরাস মোকাবিলার পরিসর বাড়াতে চায় কেরালা সরকার।

কেরালার শক্তি তার রাজনীতি
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এ ধরনের নানা উদ্যোগের মূলে রয়েছে কেরালা সরকারের উন্নয়নদর্শন। ‘গুজরাট মডেল’ যখন মূলত জিডিপি ও প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেয় এবং বিলিয়নিয়ার তৈরি করে, কেরালার সরকার তখন বছরের পর বছর গুরুত্ব দিয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়নে। মহামারির বর্তমান ঢেউয়ের মধ্যেই রাজ্যে পরবর্তী ঢেউ মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য নিয়ে কেরালায় এ রকম সতর্কতার বড় কারণ, রাজ্যের মানুষ খুবই রাজনীতিসচেতন। এখানে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত খুবই সক্রিয় স্থানীয় সরকার রয়েছে। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিরোধী কংগ্রেস—উভয় দলের কর্মীদের পাশাপাশি রাজ্যের সাধারণ জনগণ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বিষয়ে খুবই সতর্ক ও সজাগ। মূলত, এ কারণেই রাজ্যের সব সরকারকে মুখরোচক রাজনৈতিক বুলির বদলে নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে তৎপর থাকতে হয়। অক্সিজেন ও টিকায় কেরালার সফলতা এ রাজ্যের রাজনীতিরই একটা গৌরবের দিক।

আলতাফ পারভেজ গবেষক