আমরা সবাই ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে হিসাব কষতে বসেছি, এ বছরটা কেমন যাবে। আমি তো নাসিরউদ্দিন হোজ্জার মতো বছরের পর বছর একই কথা বলছি। নাসিরউদ্দিন হোজ্জাকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘মোল্লা সাহেব, আপনার বয়স কত?’
‘৮০ বছর,’ হোজ্জা বললেন।
‘৫ বছর আগেও আপনি বলেছিলেন, আপনার বয়স ৮০ বছর। ব্যাপার কী?’
‘আমি এক কথার মানুষ। আমার কথা তো দুই রকমের হতে পারে না।’
এবার আমি ভাবছি, একটু নতুন কথা বলব। আমরা কল্পনাও করতে পারছি না, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসটা কেমন যাবে। বরং ২০২৮ সালের জানুয়ারিতে কী হবে, সেটা ভাবতে বসা যায়। তা বলার জন্য একটু অতীতের কথা বলে নিতে হবে।
আমার চোখের সামনে দেখলাম, আমাদের গড় আয়ু কীভাবে বেড়ে গেল। আমাদের গড় আয়ু পাকিস্তান আমলেও ছিল ৪৭ বছর। এখন ৭২। আমাদের গড় আয়ু ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। আমার মনে আছে, ২০ বছর আগেও আমাদের দেশে কত কম লোকের বাড়িতে ফোন ছিল। একটা ল্যান্ডফোনের জন্য কত জায়গায় কত তদবির করেছি। শেষে ডিমান্ড নোট বেরোল। অবশেষে বাসায় একটা ফোন এসেছিল বটে।
তারপর এল মোবাইল ফোন। সেই ফোন দেখতে ছিল পুলিশের হাতের ওয়্যারলেসের মতো। তার দাম ছিল দেড় লাখ, দুই লাখ টাকা। শুধু বড়লোকদের হাতে সেই ফোন দেখা যেত। ল্যান্ডফোন থেকে তাতে কল করলে ইনকামিং বিল দিতে হতো। সেই ভয়ে বড়লোকেরাও ফোন রিসিভ করতে চাইতেন না। হুমায়ুন ফরীদি একটা সেলফোন কিনেছিলেন, আফজাল হোসেন তাঁকে কল করলে আমার চোখের সামনে সেই ফোন তাঁকে কেটে দিতে দেখেছিলাম।
আমি একটা মোবাইল ফোন কিনলাম ২২ হাজার টাকা দিয়ে, লাইন এবং সেটসহ।
একদিন আমাদের ভোরের কাগজ-এর সহকর্মী রিকশায় আমার হাত থেকে সেই মোবাইল ফোনটা নিয়ে কানে ধরে রেখে বলেছিলেন, সবাইকে ভাব দেখাচ্ছি যে আমার একটা মোবাইল ফোন আছে। সেই ফোন কেবল ঢাকার ভেতরেই কার্যকর ছিল।
তারপর এল শুধু জিপি টু জিপি। তারপর এল ন্যাশনাল রোমিং। আমি যখন প্রথম মোবাইল ফোন নিয়ে রংপুরে যাচ্ছি বাসে, আমার সে কী উত্তেজনা যে এই নম্বর থেকে আমি বাসে বসেও কথা বলতে পারছি। হায়, হায় দুনিয়া কত এগোল। এরপর ইত্যাদি অনুষ্ঠানে হানিফ সংকেত কৌতুক দেখালেন, বাজারে তরকারিওয়ালা, মুরগিওয়ালার হাতে ফোন। এখন ওই কৌতুক যে পরিবেশিত হয়েছিল, সেটাই কৌতুক। আর ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের লাইন ছিল ৮ কোটিরও বেশি। প্রথম যেদিন শুনলাম, মোবাইল ফোনের পর্দায় ভিডিও দেখা যাবে, সেদিনও বিস্মিত হয়েছিলাম। আর এখন? পৃথিবীর কোন প্রান্তে কে আছেন, তাঁর সঙ্গে চাইলে এখনই ভিডিও কথোপকথন করতে পারি।
১৯৯৮ সালের কথা মনে আছে, কারণ ওই সময় প্রথম আলো বেরিয়েছিল। তার ১০ বছর পরে ২০০৮, তার ১০ বছর পরে ২০১৮। এই ২০ বছরে দুনিয়াটা কী দ্রুতই না বদলে গেল। মোবাইল ফোনের বদলটা কিন্তু বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গেই ধরে ফেলেছে। আমার মনে আছে, ২০০৬ সালে আমেরিকার বোস্টনে গিয়ে দেখি, অনেকের হাতেই মোবাইল ফোন নেই। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, আমাদের ঢাকায় তো সবার হাতেই মোবাইল ফোন। আপনারা চলেন কী করে!
২০১৭ সালের শরতে আমরা গিয়েছিলাম আমেরিকায়। সেখানে বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাপক ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার বন্ধুদের কল্যাণে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ইন্টেলের কার্যালয়ে আর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ড্যাভিসের গবেষণাগারে।
ইন্টেলে গিয়ে দেখেছি ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি প্রিন্টার। ড্যাভিসের গবেষণাগারের প্রধান বাঙালি বিজ্ঞানী এম সাইফ ইসলামের কাছ থেকে শুনেছি ন্যানোটেকনোলজিতে কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে। আমেরিকাতেই একজন প্রবাসী বাঙালি আমাকে চড়ালেন তাঁর চালকবিহীন আর ইঞ্জিনবিহীন গাড়িতে। ওই গাড়ি চলে বিদ্যুতে, তাই ইঞ্জিন নেই আর হাইওয়েতে উঠে অটো মোডে দিয়ে দিলে সে নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিতে পারে, চালক দরকার হয় না।
এসব দেখেশুনে একটা বিষয় বুঝতে পারছি, আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমাদের হাতের মোবাইলটা হবে ভীষণ ক্ষমতাসম্পন্ন আর ইন্টারনেটের গতি হবে অনেক অনেক গুণ বেশি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বাস্তব প্রয়োগ হবে একটা সাধারণ ঘটনা। এখনই মোবাইল ফোন চোখের ইশারা বোঝে। তখন মনের ভাবও বুঝবে। তাকে বলতে হবে না যে এখন তুমি ওকে কল করো বা আমার জন্য রবীন্দ্রনাথের কবিতা খুঁজে বের করো। আমার মাথার চিন্তা কম্পিউটার নিজেই পড়ে ফেলবে। আর আমার হাতের মোবাইল ফোনটাই হবে অনেক গুণ শক্তিশালী কম্পিউটার। এখনই বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, যিনি নড়তে-চড়তে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, তাঁর চিন্তা কম্পিউটার বলে দিতে পারে, এভাবে তিনি দিব্যি বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, শ্রোতাদের প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি হবে বিস্ময়কর। ন্যানোটেকনোলজি, বায়োবট এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বহু রোগ নির্মূল করতে পারবে, বহু রোগের চিকিৎসা বেরিয়ে যাবে। মানুষের গড় আয়ু আরও বাড়বে এবং মানুষের রোগশোক অনেকটাই কমে যাবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর পরিবর্তন সমাজকেও ওলট-পালট করে দিচ্ছে। আমরা জানি, লাঙল আবিষ্কারের পরে আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজ, সেখান থেকে সামন্তবাদ উদ্ভূত হয়। যন্ত্র কলকারখানার আবিষ্কারের ফলে আসে পুঁজিবাদ। এখন আমরা আছি চতুর্থ বিপ্লবের সময়ে। উৎপাদনযন্ত্র বদলে গেলে উৎপাদনব্যবস্থা বদলে যায়, উৎপাদনব্যবস্থা উৎপাদন সম্পর্ককে বদলে দেয়। এখন ইউটিউবে নিজের পছন্দের খেলনার সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে ৫ বছরের বালক কোটি কোটি টাকা আয় করতে পারে। বিল গেটস, জাকারবার্গ পৃথিবীর অন্যতম ধনী হয়েছেন বুদ্ধি দিয়ে, নতুন প্রবর্তনা দিয়ে।
আর এদিকে বাংলাদেশে এখন প্রায় ৯৯ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। এরা অনেকেই ১০ বছর পরে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে। ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে চলে যেতে আমাদের।’ আমরা অনেকেই থাকব না, যারা পুরোনোপন্থী, যারা এখনো হাতে চিঠি লিখে যোগাযোগে বিশ্বাস করি। ফলে নতুন-পুরোনোর দ্বন্দ্বের একটা অংশ নিজে নিজেই সমাধান করবে।
এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের যদি আমরা নতুন যুগের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে তারা পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে আরেক প্রান্তের কর্মযজ্ঞে যোগ দিতে পারবে।
কিন্তু এসবের ফলেও বাংলাদেশে ও বিশ্বে রাজনীতিতে নতুন আশাবাদের ক্ষেত্র তৈরি হবে, তা বলা মুশকিল। যে যুগে আমরা বসবাস করছি, সেটাও জ্ঞানবিজ্ঞানের এক চরম উৎকর্ষের যুগ, এই যুগেই তো ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, যিনি অপরিণত বালকের মতো সব টুইট করেন, এখন ঝগড়া করছেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে, কার পারমাণবিক বোমার সুইচ বেশি মোটা তাই নিয়ে। খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। এ এমন এক লোক, যিনি মনে হলো আর অমনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন আর পৃথিবীটাকে করে তুললেন আরেকটু অশান্ত। জাতিসংঘে এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনা হলে তিনি বলে দিলেন, দেখি কে আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দেয়, কিছু টাকা আমার বেঁচে যাবে।এ এমন এক যুগ যখন ব্রেক্সিট জয়লাভ করে ভোটে। আর? আর আমাদের পাশের দেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা, নারী নির্যাতন, শিশুহত্যার ঘটনায় জাতিসংঘের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয় চীন আর রাশিয়া। মানে সবাই চলে স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার—এগুলো আসলে কথার কথা, তথাকথিত উন্নত বিশ্বই এসবের এক পয়সা দাম দেয় না।
২০২৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবী টিকে থাকবে তো? স্টিফেন হকিং মনে করেন, পৃথিবী ঝুঁকিতে আছে, কাজেই পৃথিবীর বাইরে মানুষের বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যদি মানুষ প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকতে চায়। এই বিপদ আমরা সৃষ্টি করেছি। এত অস্ত্র আর বোমা বানিয়ে রেখেছি যে তা পৃথিবীটাকে কয়েকবার ধ্বংস করে দিতে পারে। আর জলবায়ুর পরিবর্তন তো এখন কেবল গাণিতিক বাস্তবতা নয়, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা।
২০২৮ সালে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থা কী দাঁড়াবে। এটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমরা সবচেয়ে ভালোটা আশা করি, তবে সবচেয়ে খারাপটা এলেও যেন তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকি।
জনসংখ্যা বাড়বে, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ঘটবে, প্রবাসী আয় বাড়বে, জমির দাম বাড়বে, তার মূল্য দেবে এই দেশের নদী, বন, মাটি আর আকাশ। পরিবেশ হবে আমাদের উন্নতির এক নম্বর বলি। একমাত্র সুশাসনই পারে পরিবেশের এই মহাবিপর্যয় থেকে দেশটাকে রক্ষা করতে। সুবচন দিয়ে সুশাসন আনা যাবে না। এ বিষয়ে আমি কোনো আশার কথা শোনাতে পারছি না।
কিন্তু আমি বলতে পারব, ২০৩৮ সাল আমাদের ভালো হবে। কারণ, একটা তত্ত্ব আছে, গরিব দেশে সুশাসন আসে না। আমরা দ্রুতই মধ্য আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ হয়ে যাব, তখন আমাদের বড়লোকেরা বলবেন, এত দামি গাড়ি, চলার রাস্তা নেই, এত টাকা আয় করি, শ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস নেই, তাকানোর মতো আকাশ নেই। আচ্ছা, এসো, এসব ঠিক করে ফেলি। পুঁজি নিজের স্বার্থে নিজেকে পাহারা দেবে।
অথবা দেশটা পরিত্যক্ত দেশে পরিণত হতেও পারে। সবাই তো বিদেশে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখছেন। দেশের আয় বিদেশে পাঠাবেন, ছেলেমেয়েদেরও।
কিন্তু আমরা আশাবাদী। কারণ, এখন মানুষই সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর আমাদের আছে মানুষ। আমরা হারব না, যদি আমাদের মানুষ থেকে থাকে অথবা আমরা মানুষ থেকে থাকি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।