দেশজুড়ে বইছে উত্তুরে হিমেল হাওয়া। এর মধ্যে নির্বাচনী হাওয়াও বইছে বেশ জোরেই। শীত চলে যাবে আট-দশ দিন বাদেই। আবহাওয়া ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। সেই উত্তাপ ছড়াবে রাজনীতির মাঠে। তার আগাম আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন কথা–চালাচালি হলো সার্চ কমিটি নিয়ে, আগে এটা ছিল রাষ্ট্রপতির ‘প্রেরোগেটিভ’। এখন তা আইনি ভিত্তি পেয়েছে। এটাকেই বলা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন আইন। এই আইনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে একটি সার্চ কমিটি তৈরি হয়েছে। তারা নির্বাচন কমিশনের জন্য সম্ভাব্য ১০ প্রার্থীকে বাছাই করবে। তাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন।
এত দিন শোনা গিয়েছিল, শিগগির আইন তৈরির সম্ভাবনা নেই। আইনমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, এ জন্য সময় লাগবে। হঠাৎ দেখা গেল একটা আইনের খসড়া তৈরি হয়ে গেল। এ নিয়ে নাকি মাসখানেক ধরে চিন্তাভাবনা চলছিল। বোঝা যায়, আইনমন্ত্রী এটা জানতেন না। তাঁর জন্য আমিই লজ্জা পাচ্ছি।
সবাই একটা আইন চেয়েছিলেন। কোনো দল থেকে আজ পর্যন্ত এই আইনের রূপরেখা কী হবে, তা তুলে ধরা হয়নি। আইনটির খসড়া ঘোষণা থেকে সংসদে পাস হয়ে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো দল দুই-একটি প্যারাগ্রাফ লিখে দেখায়নি যে আইনটি এ রকম হওয়া দরকার বা হতে পারে। এখন সব আলোচনা হচ্ছে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনাকে ঘিরে—হবে কি হবে না।
সার্চ কমিটির জন্য একটা টার্মস অব রেফারেন্স তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। যেমন নির্বাচন কমিশনারের বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে, যেকোনো প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ২০ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, এ রকম ব্যক্তি আছেন কোটি কোটি। কমিশনের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা আরও সুনির্দিষ্ট করা দরকার ছিল। এখন তো যে কাউকে নিয়োগ দিয়ে বলা যাবে যে তাঁর বয়স তো এত কিংবা তিনি অমুক সরকারি বা সওদাগরি প্রতিষ্ঠানে এত বছর কাজ করেছেন। আর যাঁরা স্বনিয়োজিত, কোথাও কখনো চাকরি করেননি, এমন লোকও তো আছেন কোটি কোটি, যেমন কৃষক কিংবা কারিগর ও শিল্পী। তাঁরা বাদ।
কমিশন যেমনই হোক না কেন, তাদের তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন হবে। বিদেশিরা এসে এ দেশে নির্বাচন করে দিয়ে যাবে না। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন সম্ভব কি না। গত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
সরকার যেহেতু বলেছে, আইন যেহেতু হয়েছে, কমিশন একটা হবেই। এ মাসের ১৪ তারিখ বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। হাতে সময় আছে এক সপ্তাহ। এর মধ্যে সার্চ কমিটি নিজেদের মধ্যে বৈঠক করবে, সলা-পরামর্শ করবে, প্রার্থী যাচাই-বাছাই করবে, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। সিদ্ধান্ত কী ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দ অনুযায়ী হবে, তা-ও জানি না। এত অল্প সময়ে এত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কাজটি ঠিকমতো করতে পারলে তো তাদের সুপারম্যান-উইমেন বলতে হবে। বিরোধীরা অবশ্য মনে করে নির্বাচন কমিশনে কারা আসছেন, তা ইতিমধ্যে ঠিক হয়েই আছে। বাকি আছে শুধু আনুষ্ঠানিকতা।
অতীতের কমিশনগুলোর বিন্যাস থেকে এটা মোটামুটি আন্দাজ করা যায় যে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই কমিশন আলোকিত করে রাখবেন—পাঁচজনের অন্তত তিনজন। এসব কর্মকর্তা সরাসরি রাজনীতি না করলেও রাজনৈতিক পক্ষপাত নেই, এটা বলা যাবে না। দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নানান কমিশনে নিয়োগ পাওয়ার জন্য চেষ্টা বা লবি থাকে। অবসরের পর পুনর্বাসনের জন্য এ ধরনের একটি কমিশনের সদস্য হওয়ার চেয়ে মজার চাকরি আর কী হতে পারে!
নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের থাকে না। তাকে নির্ভর করতে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মর্জি এবং প্রশাসনের সহযোগিতার ওপর। নির্বাচনে হেরে যাওয়া মানেই ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’—বড় রাজনৈতিক দলগুলো এমনটাই মনে করে। এ কারণে তারা জেতার জন্য মরিয়া। নাগরিকদের অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিলে এবং সেই ভোটের মাধ্যমে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হলে, আমরা তত্ত্বগতভাবে বলতে পারব যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। প্রশ্ন হলো, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না। আমার জানামতে, ১৯৫৪ সালের পর এ দেশে এর নজির নেই। ঠিক এ কারণেই আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছিল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে বিএনপি ও তার মিত্ররা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিল। শেষমেশ বিএনপির ১৫ ফেব্রুয়ারির সংসদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আইনটি পাস হয়। এটা তারা স্বেচ্ছায় করেনি। আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে তাদের বাধ্য করেছিল দাবি মেনে নিতে।
অবস্থা এখন পাল্টেছে। আওয়ামী লীগ এখন সরকারে। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থাপত্রটি বাতিল করে দিয়েছে। তারা মনে করেছে, এ ব্যবস্থায় তাদের অসুবিধা হবে। বিএনপি দেখছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে জয় পাওয়ার সম্ভাবনা তাদের নেই। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি একটু ব্যাকফুটে আছে। কারণ দলটি একটা ‘আন্দোলন’ তৈরি করে দাবি মেনে নিতে সরকারকে বাধ্য করতে পারছে না।
নির্বাচন কমিশনের কথায় ফিরে আসা যাক। কমিশন যেমনই হোক না কেন, তাদের তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন হবে। বিদেশিরা এসে এ দেশে নির্বাচন করে দিয়ে যাবে না। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন সম্ভব কি না। গত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
যে নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালের নির্বাচনের আয়োজন করেছিল, তাকে অনেকেই একটি আদর্শ কমিশন মনে করেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। ওই সময় যাঁরা সরকারে ছিলেন, তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেননি, তাঁরা তখন উপজেলা নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বড় দুটি দল রাজি না হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালের পর আর ক্ষমতায় থাকতে চায়নি। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচন হয়। নির্বাচনটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা তখন বলেছিলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। সুতরাং কমিশনে পাঁচজন ফেরেশতা এনে বসিয়ে দিলেই যে ভালো নির্বাচন হবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
আওয়ামী লীগ যদি মনে করে তারা পরবর্তী মেয়াদেও ক্ষমতায় থাকবে, তাহলে তাদের নিশ্চয়ই একটা রণকৌশল থাকবে। সেটি কী? ২০১৪ সালে আমরা একরকম দেখেছিলাম। ২০১৮ সালে দেখলাম অন্য রকম। ২০২৩ সালে কেমন খেলা হবে? বিএনপি এখন পর্যন্ত বলে আসছে, দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। এটি তারা ২০১৮ সালেও বলেছিল। তারপরও তারা নির্বাচনে গেল। তখন কি নেপথ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছিল, যা টেকেনি। বিএনপি নেতারা মনে মনে ভাবতে পারেন, কেউ কথা রাখেনি।
বিএনপির এখন যে অবস্থান, তা কতটা নীতিগত আর কতটা কৌশলগত, তা তারাই ভালো বলতে পারবে। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয়, তারা দাবি থেকে একচুলও সরে আসবে না। কিন্তু আড়ালে কী কথাবার্তা হয়, তা আমরা জানি না। সরকার কি খুব চাপে আছে? তারা কি বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির একটা ফর্মুলায় যাবে? এসবই হলো আন্দাজনির্ভর কথাবার্তা। নেতাদের মন বোঝা ভার। তবে প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ একটানা এত বছর সরকারে আছে বলেই দেশে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে। ‘উন্নয়নের’ জন্য আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাটা জরুরি। এখন সবার নজর থাকবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশলের দিকে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক