অবিশ্বাস্য! দিল্লির বিধানসভার নির্বাচনে এই ফলাফল হবে কোনো নিরীক্ষক বা বিশ্লেষক ভাবেননি। জরিপেও বলা হয়েছিল, সম্ভবত একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (এএপি) জিতবে। কিন্তু মোদি-ম্যাজিকের রেশ থাকতে থাকতেই যে এভাবে তাঁর দল বিজেপির ভরাডুবি হবে এবং কংগ্রেস হয়ে যাবে নিশ্চিহ্ন, এটা কিন্তু কেউ কল্পনাও করেনি। আমার মনে হয় ভারতে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর মধ্যে দিল্লি বিধানসভার এই সাধারণ নির্বাচন বিভিন্ন কারণে স্বতন্ত্র, গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ বার্তাবাহক। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এটি একটি বিরাট রাজনৈতিক ‘সুনামি’। ‘সুনামি’ আকস্মিক আসে, বিধ্বংসী তাণ্ডব করে চলে যায়। আমার কাছে মনে হয়, এটা তা নয়। এটি একটি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও প্রত্যাখ্যানের বহিঃপ্রকাশ, যদিও খুব অল্পকালের মধ্যেই এর সঞ্চার। এটা অবশ্যই বিধ্বংসী, কিন্তু এটা চলে যাবে না, এর প্রভাব রয়ে যাবে এবং ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করবে।
বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য মনোনীত কিরণ বেদী, (যিনি নিজেও নির্বাচনী এলাকা থেকে হেরেছেন) বলেছেন, ‘এটা আমার পরাজয় নয়, এটা জাতীয় দল বিজেপির পরাজয়।’ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই বক্তব্য। দিল্লি বিধানসভার ৭০ আসনের মধ্যে ৬৭টিই জিতেছে এএপি। কংগ্রেস একটিও আসন পায়নি। আর বিজেপি মাত্র তিনটি আসন পেয়েছে। এএপি এককভাবেই পেয়েছে ৫৫ শতাংশ ভোট। বিজেপি মাত্র ৩৩ শতাংশ। আর কংগ্রেস ১০ শতাংশ। অন্যরা ২ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, এএপির বিজয় একটি সামগ্রিক ব্যাপার, সামান্য ভোটের ব্যবধানে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে জেতা নয়।
কংগ্রেসের মনোনীত নেতা অজয় মাকেন, যিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক, বিরাট ভোটে হেরেছেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিতনয়া শর্মিষ্ঠা মুখার্জি, যাঁর নির্বাচনী এলাকা গ্রেটার কৈলাশে যথেষ্ট বাঙালি-অধ্যুষিত। তিনিও হেরেছেন গো-হারা। দিল্লির নির্বাচনী কংগ্রেসপ্রধান চাক্কো পদত্যাগ করেছেন। ২০১৩ সালেও কংগ্রেসের আটটি আসন ছিল। এবার যে সবগুলো এভাবে হারবে, তা হয়তো তারা ভাবেনি। অথচ এই এলাকায় কংগ্রেসের রথী-মহারথীদেরই বাস এবং তাঁরা নির্বাচনী প্রচারে পুরোপুরি অংশ নিয়েছেন।
আর বিজেপি। ওটা তো সব শক্তি-সত্তা নিয়েই অবতীর্ণ হয়েছিল। দলের সভাপতি অমিত শাহ ও জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী অরুণ জেটলি চষে বেড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং অংশ নিয়েছেন নির্বাচনী প্রচারে। কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি। দুর্নীতি ও অযোগ্যতার অভিযোগ-দুষ্ট কোনো অভিজ্ঞ রাজনীতিককে মনোনয়ন না দিয়ে এবং জিতলে তাঁদের কারও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারে ঘুচিয়ে দিয়ে নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী পদের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কিরণ বেদীকে দাঁড় করিয়েছিলেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা কিরণ বেদী, ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের উচ্চতম কর্মকর্তা, কারাগার মহারক্ষক হিসেবে যাঁর সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতা প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছিল।
এএপিপ্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালও কিন্তু একজন আমলা ছিলেন। সাম্প্রতিক কালে তিনি পদত্যাগ করে রাজনীতিতে এসেই ২০১৩ সালের নির্বাচনে আম আদমি পার্টি গঠন করে জিতে গিয়েছিলেন। কেজরিওয়ালের ছিল সততার সুনাম, কিন্তু তিনি উচ্চপদস্থ কেউ ছিলেন না। দেখা গেল, ভোটাররা সম্ভবত প্রার্থীর ব্যক্তিগত গুণপনা বিচার না করে প্রধানত চয়ন করেছেন পার্টির ভিত্তিতে। বিজেপি ও কংগ্রেসের সব স্বনামধন্য-অভিজ্ঞ রাজনীতিকই তুলনামূলকভাবে অনভিজ্ঞ এএপি মনোনীত প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। কিরণ বেদীর কথাই ঠিক, তিনি হারেননি। হেরেছে বিজেপি। জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়ের পরেও এই রাজধানী-রাজ্য নির্বাচনে এএপি পেয়েছে অতিরিক্ত ৩৯ আসন।
স্বল্প সময়ে এই মহাপরিবর্তনের কারণ বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি সত্য প্রতিভাত হয়:
১. দিল্লি ভারতের সর্বাধিক কসমোপলিটন এলাকা। বহু রাজ্যের লোকই এখানকার অধিবাসী ও ভোটার। সুতরাং এই নির্বাচনী ফলাফল কোনো বিশেষ রাজ্য, ভাষা বা বর্ণ বা এলাকাভিত্তিক নয়। এখানে একটি সামগ্রিক রূপ পাওয়া যাচ্ছে এবং তাদের কাছে বিজেপির আবেদন ভীষণভাবে কমে গেছে।
২. এটা অনস্বীকার্য যে বিজেপি একটি সাম্প্রদায়িক দল। যার মূলমন্ত্র হিন্দুত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ‘ঘর ওয়াপসি’ বা স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের স্লোগানে তারা ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের অর্থের প্রলোভন এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভয়ও দেখিয়েছে। এমনকি দিল্লির জামে মসজিদের ইমামকেও তারা ঘর ওয়াপসিতে হিন্দুধর্মে দীক্ষা নিতে আহ্বানের ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। সম্প্রতি মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়েছে, খ্রিষ্টান চার্চেও হয়েছে আক্রমণ। সম্ভবত ভারতের ‘সেক্যুলার’ জনসমাজ এই নীতিটি গ্রহণ করতে অপারগতা দেখতে যাচ্ছে। এ বাণী পৌঁছানোর জন্য সম্ভবত বহু কংগ্রেস সমর্থকও এএপিকে ভোট দিয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করতে চেয়েছেন। তাঁরা জানতেন, কংগ্রেস তো জিতবে না।
৩. অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা ও ‘রামজাদা বনাম হারামজাদা’ ইত্যাদির ঘোষণা, চার্চের ওপর আক্রমণ, নারীদের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি সরকারের ওপর বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও নারীদের বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে কেন্দ্রীয় সরকারি দলের প্রতি। ‘সংখ্যালঘু’ ভোটারদের অবজ্ঞা করার যে প্রবৃত্তি বিজেপিতে দেখা গেছে, এটার একটি জবাব দেওয়ার জন্যই সম্ভবত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিজেপিবিরোধী হয়েছে।
৪. বিজেপির শাসনে প্রাধান্য পাচ্ছে ধনী সম্প্রদায়, উচ্চবংশীয় ও উচ্চশিক্ষিত হিন্দুরা, অভিবাসী সম্প্রদায়। তুলনামূলকভাবে কম সচ্ছল বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই এক বছরেই ধারণা করেছে, তারা উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে। তাই এই সুযোগে প্রত্যাখ্যানের একটি প্রমাণ দিতে তারা চেয়েছে।
৫. ভারতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে যাচ্ছে, এই একটি ধারণা জন্মানো শুরু করেছিল। ‘মোদি বা’ ব্যক্তিপূজা একটি রেওয়াজ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। ভোটাররা সম্ভবত তা চান না।
আমরা আশা করি প্রতিবেশী দেশে সাম্প্রদায়িকতার জয় হবে না এবং সাম্প্রদায়িক স্লোগান বা মতবাদ সেখানে প্রতিষ্ঠা পাবে না। তাই নির্বাচনের এই ফলাফলকে আমরা স্বাগত জানাই।
তবে বাংলাদেশে আমাদের কিন্তু ভারতের এই নির্বাচন থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে।
প্রথমেই দেখা যাচ্ছে জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বা মতামত প্রকাশের সুযোগ ও সুবিধা কী চমৎকারভাবে দেওয়া হলো। ওখানে ‘প্রেসিডেন্টের রুল’ জারি করে বিজেপির আধিপত্য বজায় রাখার কোনো অপচেষ্টা হলো না। দ্বিতীয়ত স্থায়ী প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও আইন রক্ষাকারী সংস্থাগুলো যেমন পুলিশ, কী প্রশ্নাতীতভাবে দলনিরপেক্ষ হয়ে সুচারুরূপে তাদের ভূমিকা পালন করল। নির্বাচনের পুরো ফলাফলের আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিজয়ী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে পরাজয় বরণ করে কেন্দ্রের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন।
আমাদের দেশে এ ধরনের গণতান্ত্রিক আচরণ, নিরপেক্ষ প্রশাসন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি কি সম্ভব নয়? অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই ছিল তো সত্যিকারের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, আর সবার সম–অধিকার প্রতিষ্ঠা। সেই চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা বেছে নিচ্ছি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সন্ত্রাস ও সহিংসতা, দলীয় প্রশাসন নিপীড়ন। গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের সুযোগ দিলে তো সন্ত্রাস ও সহিংসতা মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পাবে না। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা না করতে দিলে এবং প্রশাসনিক নির্যাতনে তো চরমপন্থীদেরই অভ্যুদয় হবে, এটা তো সর্বস্বীকৃত সত্য।
ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী, ড. এটিএম শামসুল হুদা, ড. বদিউল আলম মজুমদার, মাহমুদুর রহমান মান্না, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং আরও যে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সমঝোতা ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন, তাকে নাকচ করে দেওয়া কি উচিত হয়েছে? সহিংসতা-সন্ত্রাস অবশ্যই পরিত্যাজ্য। তবে সমঝোতা ও সংলাপ ছাড়া সমস্যার সমাধান তো অন্য কিছুতেই হবে না। এই বোধোদয় কি হবে না?
পরমতসহিষ্ণুতাই হচ্ছে দিল্লি নির্বাচনের বাণী। সেটাকে চলুন আমরা গ্রহণ করি।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।