কেউ তাকে কথা দেয় না, দিলেও সে কথার দাম রাখে না। সে কিন্তু বারবার ঠিকই কথা রেখেছে। করোনা সংকটের কালে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েও সবচেয়ে বেশি ভরসা জুগিয়ে গেছে তারা। নামে তারা রহিমুদ্দি, করিমুদ্দি হলেও কাজের বেলায় একেবারে রুস্তম পালোয়ান। বাস্তবে দেখতে জিরজিরে শরীরের হলেও তাকদে তারা শিল্পী জয়নুল কিংবা সুলতানের কল্পনার সমান। সে বাংলাদেশের কৃষক।
২০২১-এর প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের কৃষকের একটা জাতীয় অভিবাদন প্রাপ্য।
মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষককে আহত করলেও কাবু করতে পারেনি। ১৮৭১ সালে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের প্রথম আদমশুমারিতে প্রধান শুমারিকার বেভারলি সাহেব লিখেছেন, বাঙালিদের দেখতে নাজুক লাগলেও জলে ও ডাঙায় বিচরণকারী এ উভচর, যা সামলাতে পারে, তা করতে গিয়ে যেকোনো হিন্দুস্তানি ভেঙে পড়ত।
অতীতের কথা থাক, ২০২০ সালে দুই দফার বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আম্পান সামলে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন অনাদিকালের সেই কৃষক। লকডাউনের মধ্যেও যে মানুষ কষ্টে হলেও খেতে পেয়েছে, সেটা কার কৃতিত্ব?
করোনাকালের বীর তো তাঁরাই। তৃতীয় দুনিয়ার সুপারম্যান সুপারউইমেন পিঠে ঝালর লাগিয়ে উড়ে বেড়ান না, তাঁরা কাজ করেন খেতে-খামারে আর তাঁদের সন্তানেরা গতর খাটে গার্মেন্টসে আর মধ্যপ্রাচ্যে। করোনাকালে যে খাদ্য উৎপাদন ও রেমিট্যান্স দুটোই মোটামুটি বহাল অবস্থায় ছিল, তারও কৃতিত্ব বৃহত্তর কৃষকসমাজের। লকডাউনে বা দুর্যোগে সব যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখনো দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে কৃষক চালিয়ে যান সভ্যতার প্রথম পেশা—কৃষি।
করোনা মহামারি হয়তো ২০২১-এও থাকবে। তখনো আমাদের খাদ্যের জোগান যাঁরা দিয়ে যাবেন, তখনো কি আমরা প্রতি লোকমা ভাতে, প্রতি কেজি শস্যে সেই কৃষকের সঙ্গে বেইমানি করে যাব?
অথচ প্রতি লোকমা ভাতে আমরা বেইমানি করি। প্রতিটি বাজেটে সরকার তাঁদের বঞ্চিত করে। প্রতিটি পদক্ষেপে শহরের মালিকেরা বেইমানি করেন কৃষকের সঙ্গে। যাঁরা ধান বেচা লোক, যাঁরা খাদ্যের জোগানদার, তাঁদের আলাপ জমে না টক শোতে। তাঁদের দাবিতে উত্তেজিত হয় না রাজপথ। উন্নয়নের উড়ালসড়ক তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় । তাঁদের সন্তানদের শ্রম বেচার ব্যবসা করে রাষ্ট্র ডলার আনে বিদেশ থেকে। তাঁদের মেয়েদের গতর খাটুনি থেকে ডলার আসে গার্মেন্টস মালিকের ঘরে। তাঁদের সন্তানেরাই ধসে মরে রানা প্লাজায়, গণকবরে শোয় থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। কৃষকের উন্নতি আর শহরবাসী ভদ্রকুলের উন্নয়ন পূর্ব আর পশ্চিমের মতো, তাঁদের কখনো হয় না মুখ দেখাদেখি।
কেন বলছি এত কথা? বলছি কারণ, এবারও ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষক।
কৃষি তো একধরনের ব্যবসাও বটে। এই ব্যবসায় লাগে জমি, লাগে পানি, লাগে বীজ, লাগে খোলা আকাশের নিচে রোদে-বৃষ্টিতে হাড়ভাঙা খাটুনি। তারপর যা হয়, তা বেচতে গিয়ে কৃষক দেখেন দাম নেই। এ এক আশ্চর্য অর্থকরী জাদু—সবকিছুর দাম বাড়ে, কমে শুধু কৃষকের ধান আর জীবনের দাম। এবারও বোরো ধান চাষ করে লাভের মুখ দেখেননি কৃষক। দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে সারা বছরের খাটাখাটুনির মূল্য বাদ দিয়েও নগদ টাকার যে খরচ, তা-ও উঠে আসছে না। ১০০ টাকা খরচ করে বিক্রির সময় মিলছে মাত্র ৮২ টাকা কিংবা আরও কম।
অথচ বাজারে যান, মুনাফার স্বার্থে ব্যবসায়ীদের তৈরি করা সংকট বাদে চালের অভাব নেই, সবজি ও আনাজের অভাব নেই, মাছের অভাব নেই। শীতের আসল উৎসব তো সবজিতেই সারা। শিশুর হাসির মতো ফুলকপি, গম্ভীরা রমণীর মতো পাতাকপি, মেমসাহেবের মতো সাদা মুলা, রাঙা মামির মতো লাল মুলা, নাচের কোমরের বাঁকের মতো শিম, সবুজ মুক্তাদানার মতো মটরশুঁটি, লাবণ্যময়ী নারীর মতো লাউয়ের ত্বক।
আর নতুন আলুর স্বাদের মতো, পেঁয়াজের কলির ঘ্রাণের মতো আর কী আছে! বগুড়ার গোলাপি বেগুন যেন অপ্সরীদের ঝিলিক। যেকোনো বিষণ্ন মানুষের মন ভালো হয়ে যাবে বড় কোনো বাজারে শীতের সবজির সম্ভার দেখলে। কৃষক তাঁর অপরূপ শিল্পকর্ম ছড়িয়ে রাখেন বাংলাদেশজুড়ে, তাঁর ধানখেতে, তাঁর শর্ষের ফুলবিছানো প্রান্তরে, তাঁর সবজি ফলানো বর্ণিল জমিতে।
মাছের কথা আর কী বলব। বর্ষার চেয়ে শীতের মাছের বৈচিত্র্য ও স্বাদ কোন অংশে কম? আষাঢ়ে পোনা ছাড়া মাছগুলো এখন ডগমগ যৌবনমত্ত হয়ে উঠেছে। খাল-বিল-হাওর শুকানো অল্প পানি থেকে এখনই তো তাদের বাজার হয়ে মানুষের পাতে বসে জীবনের ফজিলত বিতরণের সময়।
কৃষিতে বাংলাদেশের লা-জওয়াব সাফল্যের বর্ণনা এক কথাতেই সারা। কৃষিজমি কমেছে, জনসংখ্যা ও ভোগ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, তবু স্বাধীনতার সময়ের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জায়গায় এখন সতেরো-আঠারো কোটি মানুষকে খাইয়েও রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের শস্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।
কিন্তু এবারও সরকার কৃষকের কথা শুনছে না। যখন নতুন চাল আর পেঁয়াজ উঠতে যাচ্ছে, গতবারের মতো তখনো ভারত থেকে চাল-পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করার দুই বছরের মাথায় বাংলাদেশ গরু উৎপাদনে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার মদদ দিলে দুয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের পেঁয়াজের জন্য আর কারও কাছে ধরনা দিয়ে পড়তে হবে না।
অথচ কিনা সরকার করোনাকালের জাতীয় বীরের পেটে লাথি মেরে তাঁর ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়া তো দূরের কথা, মোটামুটি লাভ পাওয়ার সুযোগও কমিয়ে দিল অদরকারি সময়ে আমদানির সিদ্ধান্ত দিয়ে।
খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতায় কৃষকেরা বাংলাদেশকে খাদ থেকে টেনে তুলেছে। খাদের কিনারে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার কৃষক। এই অর্জন টেকসই করতে হলে কৃষককে আরও সহায়তা দিতে হবে। তার বদলে তাঁকে আরও কোণঠাসা করে কী অর্জন করতে চাইছি আমরা?
এই শহর, এই রাজধানী, এই মুনাফামুখী বাজার অর্থনীতি গ্রাম আর নদীর দিকে পেছন ফিরে চলছে। গ্রামে আগে কেউ কারও বাড়ির দিকে পেছন ফেরানো বাড়ি বানালে সালিস বসাত। তোমরা কি একঘরে হতে চাও? তোমরা কি এক উঠানের মেলামেশা চাও না? আর আমরা যে গ্রামের দিকে পশ্চাদ্দেশ দিয়ে নগরবাজি চালাচ্ছি, তার জন্য কি কোনো দিন সালিস বসবে না?
করোনা মহামারি হয়তো ২০২১-এও থাকবে। তখনো আমাদের খাদ্যের জোগান যাঁরা দিয়ে যাবেন, তখনো কি আমরা প্রতি লোকমা ভাতে, প্রতি কেজি শস্যে সেই কৃষকের সঙ্গে বেইমানি করে যাব?
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক