এত দিনে সংসদে পাস হলো কুড়িগ্রাম জেলার একমাত্র উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য জেলাগুলোয় যখন গড়ে দুটি করে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে কুড়িগ্রামে মাত্রই তা পাস হলো। কুড়িগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আজ পূরণের পথে। কিন্তু কুড়িগ্রামের কোথায় ক্যাম্পাসটি স্থাপন করা হবে, এ প্রশ্ন এখন সবার।
জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হলো সার্বিক জ্ঞান প্রচার ও চর্চাকেন্দ্র। আর আইনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক জ্ঞান উৎপাদন করবে। তা রাষ্ট্র, ধর্ম ও সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে হলেও প্রকাশযোগ্য হবে।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার এলাকা কী কী হতে পারে
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারণার সঙ্গে কতটুকু যায়, তা বুদ্ধিজীবীরা জানেন। সেই সঙ্গে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বিষয়ভিত্তিকই না, অঞ্চলভিত্তিকও বটে। অর্থাৎ কৃষিই শুধু তার গবেষণার বিষয় নয়; এ অঞ্চলের অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল তার মধ্যকার মাছ, শুশুক, কাছিম-পাখি, অণুজীব ও খনিজ সম্পদ গবেষণার বিষয়। এমনকি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতি ও যোগাযোগব্যবস্থাও।
ক্যাম্পাস নির্মাণের উপযুক্ত জায়গা কোনটি
কুড়িগ্রামের বৈচিত্র্যময় কৃষি মূলত কেন্দ্রীয়। আর ৯৮ শতাংশ চরই ব্রহ্মপুত্রে। সেগুলো আবার চিলমারী, রৌমারী ও রাজীবপুরকেন্দ্রিক। গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু বাদাম ‘চিলমারীর বাদাম’ বলে বিখ্যাত। ইস্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস: রংপুর ১৯১১-তে বলা হচ্ছে, পুরো প্রদেশের সমতল অংশের মধ্যে এখানে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময় মাছ পাওয়া যায়। কয়েক ধরনের কার্প মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রুই, কাতলা, মৃগেল, চান্দা, চেলা ও পুঁটি। মসৃণ ও তৈলাক্ত চামড়ার মাছের মধ্যে আইড়, বাগাড়, পাঙাশ, বাচা, রিটা ও ট্যাংরা। এ ছাড়া পাওয়া যায় বেলে, পাবদা ও শিঙ্গি। বিখ্যাত ইলিশের একটা জাত মাঝেমধ্যে ব্রহ্মপুত্রে ধরা পড়ে। এখন পর্যন্ত সর্বাধিক মাছ চিলমারীতেই ধরা পড়ে। গোটা উত্তরবঙ্গে নদীর মাছের রাজধানী চিলমারীকে বলা হয়।
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার ১৮৭৬ সাল তাঁর স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল-এর রংপুর অংশে মসুর, খেসারি, তিন ধরনের মুগ ডাল—সোনা মুগ, কৃষ্ণ মুগ ও ঘোড়া মুগ, মাষ-কড়ি-বোড়া-কুন্তি কালাই, ধলা বুট, লাল বুট, মটরশুঁটি, মসুর ও অড়হড়ের উল্লেখ করেছেন। দুই ধরনের তিল—কৃষ্ণ ও আউশ। কয়েক জাতের ঝাল মসলার উল্লেখ করেছেন এবং যত ধরনের পাখি ও সরীসৃপের কথা উল্লেখ করেছেন, সব কটির চারণভূমি হিসেবে ব্রহ্মপুত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। ব্রহ্মপুত্র এখনো এই বৈচিত্র্যময় ফসলের আধার।
কয়েক শ জাতের ধান ও মাছ এই ব্রহ্মপুত্রের পাওয়া যায়। যেসব ধান বিলুপ্ত হয়েছে বলে শোনা যায়, তাও মাঝেমধ্যে মেলে চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রের চরেই। চিলমারীর ওপাড়েই ব্রহ্মপুত্রের মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রাকৃতিক জাদুঘর’ মুক্তাঞ্চল রৌমারী। ভাওয়াইয়ার কথাও কি বলতে হবে? কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পক্ষে এ রকম
প্রাকৃতিক গবেষণাক্ষেত্র আর কোথায় মিলবে?
এ ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এমন একটি জায়গায় হওয়া উচিত, যাতে রেল, নৌ, সড়কসহ সব ধরনের যোগাযোগের স্টেশনগুলো ক্যাম্পাসের চারদিকে থাকে। চিলমারীর পেদী খাওয়ার বিল এমন একটি উপযুক্ত জায়গা, যে বিলের উত্তর মাথায় বাসস্ট্যান্ড, দক্ষিণ মাথায় রমনা রেলস্টেশন এবং পূর্ব প্রান্ত ধরে ব্রহ্মপুত্র আর এক কিলোমিটার দক্ষিণে চিলমারী বন্দর। ক্যাম্পাসের সুউচ্চ হলগুলোর ছাদে দাঁড়ালেই আসাম আর মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণির আহ্বান আর কোথায় পাওয়া যাবে? এ রকম যোগাযোগ ও ভূসৌন্দর্যের অধিকারী ক্যাম্পাস বাংলাদেশে আর কোথায়? এমনি তো আর হাজার বছর ধরে চিলমারী তীর্থ হয়ে ওঠেনি!
মনোগোমারি মার্টিন ১৮৩৮ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হিস্ট্রি এন্টিকুইটস, টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিকস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লিখেছেন: ‘চিলমারীতে চার শর মতো বাড়ি, যার কমপক্ষে ১০১টি বাজারকে নিবিড়ভাবে ঘিরে নির্মিত। বাকিগুলো বাগানশোভিত। প্যারিস চার্চের মতো পূজনীয় ভবন নেই। এটা আমি দেখেছি।
আমাদের মানচিত্রগুলোর মধ্যে এটি সেই জায়গা, যা লিভারপুল ও গ্লাসগো শহরের সঙ্গে তুলনীয়।’ চিলমারীতে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন চিলমারীকে ইতিহাসের সেই দিন ফিরিয়ে আনতে পারে। সম্ভবত, ভারতের নালন্দা ও তক্ষশিলায় নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ভারত সরকারের সেই চেষ্টারই অংশ। তাহলে চিলমারীতে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয় কেন? ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’।
নাহিদ হাসান কুড়িগ্রামের রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি।
[email protected]