কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে নির্বাচন কমিশনকে। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের এটাই স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রথম বড় নির্বাচন। কুমিল্লা তো বটেই, সারা দেশের মানুষ দেখতে চাইবে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে কি না। সিইসির ভাষায় ভোট জালিয়াতদের ‘ব্ল্যাকআউট’ করে দিতে পেরেছে কি না।
আর নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনা হবে ক্ষমতাসীনদের জন্য কঠিনতর পরীক্ষা। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও সাম্প্রতিক কালে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোতে যে একতরফা ও জবরদস্তির ভোট হয়েছে, তাতে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতিই মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আমরা যদি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের আগে দুটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে সেখানে দলীয় প্রতীকের চেয়ে প্রার্থীর ইমেজ জয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। ২০১২ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন আফজল খান ও বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু। সেই নির্বাচনে মনিরুল ৬৫ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছিলেন মাত্র ৩৬ হাজার ভোট। ২০১৬ সালের নির্বাচন হয় দলীয় ভিত্তিতে। ধানের শীষ নিয়ে মনিরুল পান ৬৮ হাজার এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা ৫৭ হাজার। ফলে এ কথা বলা যাবে না যে মনিরুল বিএনপির ভোটেই জিতেছেন।
এবার কী হবে? কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব পুরোনো। একদিকে প্রয়াত নেতা আফজল খানের গ্রুপ, অন্যদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের গ্রুপ। বিএনপির প্রয়াত নেতা ও সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন নাকি ঠাট্টা করে বলতেন, আফজল খান ও বাহাউদ্দিন থাকতে নির্বাচনে জয়ের জন্য তাঁর কোনো কর্মীর প্রয়োজন হবে না। গত সিটি নির্বাচনে পরাজিত মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানাকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করার পরও দলীয় বিবাদ মেটানো গেছে, বলা যাবে না। গত দুই সিটি নির্বাচনে বাহাউদ্দিন গ্রুপ পরোক্ষভাবে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হককে সমর্থন করেছে বলে অভিযোগ আফজল গ্রুপের। এবার আওয়ামী লীগ থেকে ১৪ জন মনোনয়ন চেয়েছিলেন, যাঁদের বেশির ভাগ আফজল গ্রুপের। অন্যদের টেক্কা দিয়ে বাহাউদ্দিনের অনুসারী আরফানুল হক নৌকার মাঝি হয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনোনয়নবঞ্চিত ১৩ নেতাকে ঢাকায় এনে বৈঠক করেও শনিবার পর্যন্ত নৌকা প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামাতে পারেননি। নির্বাচনী প্রচার সোমবার মধ্যরাতেই শেষ। ১৫ জুন ভোট।
সিটি নির্বাচন নিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইছে বিএনপি শিবিরেও। গত দুই নির্বাচনে মনিরুল হক হেসেখেলে জয় পেলেও এবার তাঁকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপি নেতৃত্ব তাঁকে ‘চিরদিনের জন্য’ বহিষ্কার করেছে। দলীয় নেতা-কর্মীদেরও নির্বাচনী প্রচারে নামতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও মনিরুল নিজেকে বিএনপির একজন বলে দাবি করেন। বলেছেন, দল তাঁকে ছাড়লেও তিনি দল ছাড়বেন না। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বসার ঘরে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশাল প্রতিকৃতি। বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে বিএনপি থেকে মেয়র পদে আরও একজন প্রার্থী হয়েছেন—মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন, যিনি মনিরুলের বিরোধী গ্রুপের নেতা আমিন উর রশীদ ইয়াসিনের শ্যালক।
গত সপ্তাহে কুমিল্লায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিভিন্ন পথসভায় উপস্থিত থেকে যা দেখেছি, তা হতাশাজনক। সেখানে দলীয় নেতা-কর্মীদের বাইরে কেউ ছিলেন না। প্রার্থীরা তঁার দলের কর্মীদের কাছে ভোট চেয়েছেন। কর্মীরা নেতাদের নামে স্লোগান দিয়েছেন। দলের বাইরের মানুষ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে ভোটের দিন।
তবে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে দুই হকের মধ্যে। আরফানুল ও মনিরুল। তাঁরা নিজ নিজ দলের ভেতরে ও বাইরে কত বেশি ভোট টানতে পারেন, তার ওপরই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল নির্বাচনী দৌড়ে প্রথম নেমেছেন। ভোটারদের কাছে তেমন পরিচিত নন। স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনের ইমেজ পুঁজি করেই তাঁকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে মনিরুলের চ্যালেঞ্জ হলো, যে দল তাঁকে বহিষ্কার করেছে, সেই দলের নেতা-কর্মীদের নিয়েই তঁাকে মাঠে নামতে হয়েছে। গত দুই নির্বাচনে রাজনৈতিক মহলে জোর প্রচার ছিল যে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে তিনি ভোটযুদ্ধে জয়ী হয়ে নির্বিঘ্নে মেয়াদ পূরণ করেছেন। বিএনপির অন্য যেসব নেতা মেয়র হয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে।
কুমিল্লার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, দলের ওপর ভর করে কোনো প্রার্থী জয়ী হতে পারবেন না। যিনি দলের বাইরের, বিশেষ করে তরুণদের ভোট বেশি টানতে পারবেন, তঁারই জয়ের সম্ভাবনা বেশি। আওয়ামী লীগ নিজেকে যত সবল এবং প্রতিপক্ষকে যত দুর্বল ভাবুক না কেন, স্থানীয় নির্বাচনের হিসাব–নিকাশটা ভিন্ন। যে দুই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, সেই দুটি নির্বাচনই হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবর্ণ সময়’। সে সময় বিএনপির অনেক নেতাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। কর্মীরা নৌকার ব্যাজ পরে ভোটকেন্দ্রে গেছেন ক্ষমতাসীনদের চোখ রাঙানির ভয়ে।
এবার দৃশ্যত নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ। কেউ কারও সমাবেশে বাধা দেয়নি। নির্বাচন কমিশনও মোটামুটি শক্ত ভূমিকা নিয়েছে। প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। তিনি এলাকা না ছাড়লেও সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আছেন। আগের মতো পেশাজীবীদের সঙ্গে ‘অ-নির্বাচনী’ আলোচনাও কমিয়ে দিয়েছেন।
গতবার লড়াই হয়েছিল নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যে। এবার নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হলো সাবেক মেয়র মনিরুলের ‘টেবিল ঘড়ি’। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনিরুলের অসুবিধার দিক হলো তিনি দলের সব নেতা-কর্মীকে পক্ষে পাননি। আর সুবিধার দিক হলো রাজনৈতিকভাবে যাঁরা বিএনপির বিরোধী, তাঁদের অনেকের সমর্থন পাবেন। অন্যদিকে নবাগত আরফানুলের সুবিধা হলো তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মেয়র হিসেবে ‘ব্যর্থ’ হয়েছেন, এই অভিযোগ করতে পারবেন না। আর অসুবিধা হলো সাড়ে ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি বিপুল উন্নয়নের পাশাপাশি যেসব দুর্নাম কামাই করেছে, তার ভাগীদার তাঁকেও হতে হবে।
গত সপ্তাহে কুমিল্লায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিভিন্ন পথসভায় উপস্থিত থেকে যা দেখেছি, তা হতাশাজনক। সেখানে দলীয় নেতা-কর্মীদের বাইরে কেউ ছিলেন না। প্রার্থীরা তঁার দলের কর্মীদের কাছে ভোট চেয়েছেন। কর্মীরা নেতাদের নামে স্লোগান দিয়েছেন। দলের বাইরের মানুষ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে ভোটের দিন।
কুমিল্লাবাসীর একান্ত প্রার্থনা, ভোটের লড়াইয়ে যিনিই জিতুন, নির্বাচনটি যেন না হারে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি