আগামী ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন এলেই স্বাভাবিকভাবে জনপ্রত্যাশার বিষয়টি সামনে চলে আসে। যদিও এ বিষয়ে জনগণের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। কুমিল্লার মানুষকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হয়েছে বারবার। তবু মানুষ স্বপ্ন দেখে, আশায় বুক বাঁধে। আশা এমন একটি বিশ্বাস, যা তাকে অভীষ্ট পথের দিকে নিয়ে যায়। আশা ছাড়া জীবন অন্তঃসারশূন্য। আশা হচ্ছে অসীম অন্ধকারের মধ্যেও আলো চেনার শক্তি।
প্রাচীন শহর হিসেবে কুমিল্লায় সমস্যার শেষ নেই। এক অন্তঃহীন সমস্যার শহর কুমিল্লা। নিমেষেই সব সমস্যার সমাধান যেমন সম্ভব নয়, তেমনই আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে অনেক সমস্যার আশু সমাধান সম্ভব। তবে সেটি হওয়া উচিত অগ্রাধিকার বিবেচনায়। সে জন্য আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচিত মেয়রের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এটি যেমন সত্য, তেমনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সবার সক্রিয় সহযোগিতাও অপরিহার্য। নগরীর মেয়র জনপ্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন, এটা খুব স্বাভাবিক। কারণ, একমাত্র মেয়রকেই নগরবাসীর সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যুক্ত থাকতে হয়। তাই তাঁকে ঘিরেই প্রত্যাশার পাহাড় তৈরি হয়।
যানজট এখন এই শহরের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি। নগরবাসী প্রত্যাশা করেন, নবনির্বাচিত মেয়র সমস্যাটি সমাধানে স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন। তবে এ সমস্যা সমাধানে মেয়রের ইচ্ছার পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক প্রশস্তকরণ, সড়ক ও ফুটপাত থেকে হকার ও ভ্যানগাড়ি অপসারণ, যানবাহনের চাপ কমানো, শহরে জনসংখ্যার চাপ কমানো, ব্যস্ততম সড়কে অপ্রয়োজনীয় শপিং মল, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিরুৎসাহিত করা, অবৈধ স্ট্যান্ড ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ইজিবাইক ও সিএনজির দৌরাত্ম্য কমানো সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছার সম্মিলিত সংমিশ্রণ অতীব জরুরি। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে মেয়র সমন্বিত উদ্যোগ নিলে তিনি অবশ্যই সফল হবেন বলে জনসাধারণ মনে করে। যিনিই মেয়র নির্বাচিত হোন না কেন, জলাবদ্ধতা সমস্যার দ্রুত সমাধান না করতে পারলে মেয়রকে তাতে ডুবতে হবে, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। জলাবদ্ধতা নিরসনে জলাধারগুলো অবমুক্ত করা, পানির প্রবাহ যাতে দ্রুত সরে যেতে পারে, সে জন্য খালগুলো উন্মুক্ত রাখা, পানির প্রবাহের রাস্তার ওপর কোনো স্থাপনা থাকলে স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে সেগুলো ভেঙে ফেলা, শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাল ও নালাগুলো আবর্জনামুক্ত রাখাসহ বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে নগরবাসী প্রত্যাশা করেন।
মানুষ এমন একজনকে মেয়র হিসেবে পেতে চান, যিনি নগরপিতা না হয়ে নগরসেবক হবেন। তাঁর দ্বার উন্মুক্ত থাকবে সব মতের ও পথের মানুষের জন্য। যিনি সর্বসাধারণের সমস্যা শোনার বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল হবেন। নগরবাসীর বিভিন্ন ব্যক্তিগত চাওয়া পূরণে তিনি রাগ-অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হবেন না। মানুষের অধিকার আদায়ে হবেন উচ্চকিত। যিনি স্টান্টবাজি না করে সত্যিকার অর্থেই মানুষের পাশে দাঁড়াবেন।
যানজট, জলাবদ্ধতার পাশাপাশি জনজটও এই নগরের উদ্বেগের বিষয়। ছোট একটি শহরে আনুমানিক ১০ লাখ মানুষের বাস। রাজগঞ্জ থেকে কান্দিরপাড়—সব যান চলাচল বন্ধ করে দিলেও এই সড়কে জনস্রোত চলতেই থাকে। এ অবস্থার উত্তরণ না ঘটলে অচিরেই এটি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে। তাই সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে নগর সম্প্রসারণ করা সময়ের দাবি। সদর দক্ষিণ হতে পারে এর জন্য আদর্শ স্থান। কিন্তু এই সম্প্রসারণকে এখনই একটি মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় নিয়ে এসে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলে আগামী ১০ বছরে সদর দক্ষিণ একটি নান্দনিক নগরীতে রূপান্তরিত হবে। অন্যথায় এটিও কংক্রিটের বস্তিতে পরিণত হবে। শহরে সড়ক এবং ফুটপাতের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিদ্যমান সড়কগুলো প্রশস্তকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। পুকুর, দিঘি সংরক্ষণ করতে হবে। গোমতী নদীকে হাতিরঝিলের আদলে বিনোদনকেন্দ্রে রূপান্তরিত করার পাশাপাশি শহরের যানজট নিরসনেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
১৪৫৮ সালে খনন করা ধর্মসাগরের আদি প্রাকৃতিক রূপ ফিরিয়ে আনার জন্য মেয়র সচেষ্ট হবেন বলেই জনগণের বিশ্বাস। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, শহরকে সবুজে আচ্ছাদিত করা, কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল এবং নৈশ কলেজ স্থাপন সময়ের দাবি। কুমিল্লায় বিশেষায়িত হাসপাতালের তীব্র সংকট দূরীকরণে মেয়রের উদ্যোগ শহরের স্বাস্থ্য খাতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে পারে।
এসব চাওয়ার আগে জনগণের প্রথম চাওয়া হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন। কুমিল্লাবাসী ভয়ডরহীন শঙ্কামুক্ত পরিবেশে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চান। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা মহানগর আতঙ্কের শহর নয়, পরিণত হোক উৎসবের নগরীতে; এটি কুমিল্লাবাসীর একান্ত চাওয়া।
তাঁরা আসন্ন নির্বাচনে এমন একজনকে মেয়র হিসেবে পেতে চান, যিনি নগরপিতা না হয়ে নগরসেবক হবেন। তাঁর দ্বার উন্মুক্ত থাকবে সব মতের ও পথের মানুষের জন্য। যিনি সর্বসাধারণের সমস্যা শোনার বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল হবেন। নগরবাসীর বিভিন্ন ব্যক্তিগত চাওয়া পূরণে তিনি রাগ-অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হবেন না। মানুষের অধিকার আদায়ে হবেন উচ্চকিত। যিনি স্টান্টবাজি না করে সত্যিকার অর্থেই মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। কবির ভাষায়, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন/ মানুষ হইতে হবে—এই যার পণ।’ কুমিল্লা মহানগরবাসীর এই চাওয়াটুকু খুব বেশি চাওয়া কি? আমরা আশা করতেই পারি, পথিকৃৎ কুমিল্লা থেকেই শুরু হবে ভয়ডর, শঙ্কামুক্ত ভোট উৎসবের।
● আহসানুল কবীর সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক